আল্লাহপাকের অস্তিত্ত্ব নিয়ে নাস্তিকদের কু-যুক্তি এবং বিভ্রান্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব

আল্লাহপাকের অস্তিত্বঃ কোরআনের আর্গুমেন্ট 
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
.
 “তারা কি শূন্য থেকেই সৃষ্টি হয়ে গেছে,না তারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা? না তারা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছে?বরং তারা বিশ্বাস করে না”  [১]

কুরআনের এই আয়াতগুলো আমাদেরকে আল্লাহর অস্তিত্বের একটি শক্তিশালী এবং ইন্টুইটিভ (intuitive) আর্গুমেন্টের সামনে দাড় করায়। কুরআন এখানে “ خُلِقُو ” শব্দটি ব্যবহার করেছে।  সুতরাং এই আর্গুমেন্টটি যা কিছু অস্তিত্বে আসে অর্থাৎ যা কিছু সৃষ্ট সেই সকল বস্তুর উপরেই প্রয়োগ করা যায়। আর্গুমেন্টটিকে যদি ছোট ছোট অংশে ভাঙ্গা যায় তাহলে দেখা যাবে যে কুরআন এখানে কোন কিছু সৃষ্টি  হওয়ার কিছু সম্ভাব্য উপায় বলছে।

শূন্য থেকে সৃষ্টিঃ “তারা কি শূন্য থেকেই সৃষ্টি হয়ে গেছে?”

নিজে থেকেই নিজের অস্তিত্বে আসাঃ “তার নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা?”

সৃষ্ট কোন কিছু থেকে অস্তিত্বে আসাঃ “তারা কি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছে?” এখানে কুরআন বলছে কোন সৃষ্ট বস্তুর অন্য একটি সৃষ্ট বস্তু থেকে অস্তিত্বে আসার কথা”।

আল্লাহঃ “বরং তারা বিশ্বাস করে না”।

এখন আমরা কুরআনের আয়াতগুলো থেকে বেরিয়ে একটি ইউনিভার্সাল আর্গুমেন্ট দাড় করাবো।

   ★মহাবিশ্ব সসীম।

   ★সসীম মহাবিশ্বকে অবশ্যই অস্তিত্বে আসতে হবে। সম্ভাব্য চারটি উপায় হল ( কুরআন অনুযায়ী)  – শূন্য থেকে,নিজেই নিজে থেকে, অন্য কোন সত্তা থেকে যে কিনা নিজেই সৃষ্ট এবং এমন এক সত্তা থেকে যিনি কিনা নিজের অস্তিত্বের জন্য অন্য কোন সত্তার উপরে নির্ভরশীল নন অর্থাৎ একজন নেসেসারি বিয়িং।

  ★শূন্য থেকে,নিজেই নিজে থেকে এবং সৃষ্ট কোন কিছু থেকে ( contingent being) মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে পারে না।

  ★সুতরাং, মহাবিশ্বের অস্তিত্বে আসার কারণ হচ্ছে আল্লাহ সুবাহানাতায়ালা।

মহাবিশ্ব কি সসীম?

আজ থেকে প্রায় ২৪০০ বছর পিছনে প্রাচীন গ্রিস থেকে একটু ঘুরে আসুন। পথে হয়তো লাইসিয়াম থেকে আসা কিংবা এপিকিউরিয়ানদের  বাগান থেকে বের হওয়া কারো সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন “এই মহাবিশ্ব কোথা থেকে অস্তিত্বে আসলো ?” তাহলে সে হয়তো আপনাকে বোকা মনে করে উত্তর দিতো – “আরে মিয়া একি বলেন? মহাবিশ্বের আবার শুরু আছে নাকি? এটা তো অসীম কাল থেকেই আছে। এর আবার অস্তিত্বে আসতে হবে কেন?” এই যেমন  এরিস্টটলই মনে করতেন মহাবিশ্বে, অন্য সব কিছু বিরাজমান পদার্থ থেকেই তৈরি হয়। এই ধরুন আপনি একটি বাড়ি বানাবেন।  এখন, বাড়ি বানাতে আপনার দরকার ইট,বালু,সিমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বস্তু গুলো কিন্তু মহাবিশ্বেরই অংশ। এদেরকে এরিস্টটল বলতেন “Substratum”। আর মনে করতেন এই সাব-স্ট্রাটাম হল ইটারনাল মানে অনন্ত কাল ধরেই আছে এর কোন শুরু নাই! সে যাইহোক, কষ্ট করে এত পেছনেও যেতে হবে না। এই ধরুন ফিলোসফার বার্টান্ড রাসেলকেই জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি যা বলতেন-

“The universe is just there, and that’s all.”  [২]

কিন্তু থার্মোডায়নামিক্স এর দ্বিতীয় সূত্রটি সব সময় মহাবিশ্বের একটি শুরুর দিকে ইঙ্গিত  দেয়। এই নীতি বলে যে, কোন একটি বদ্ধ ব্যবস্থা (Closed System) সব সময় একটি সাম্যাবস্থার দিকে আগায়। অর্থাৎ সময়ের সাথে সাথে এন্ট্রপি বেড়ে একটি তাপীয় মৃত্যুর দিয়ে আগায়। সুতরাং আমাদের মহাবিশ্ব যেহেতু সম্মিলিত ভাবে একটি বদ্ধ ব্যবস্থা,তাই অসীম কাল থেকে এর অস্তিত্ব থাকলে এটি এখন  তাপীয় মৃত্যুর অবস্থায় থাকতো। আপনি এই লেখা পড়ার জন্য এখানে থাকতেন না কিংবা আমি এই লেখা লেখার জন্যও হয়তো থাকতাম না। যাই হোক এখানে আমরা কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর নির্ভর করে আগাবো না। কারণ, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ টির মত কজমোলজিকাল থিওরি  রয়েছে যেখানে কিছু তত্ত্ব বলে মহাবিশ্ব চিরস্থায়ী  (eternal) আর কিছু বলে মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট শুরু আছে।

এক্ষেত্রে আমরা কিছু এনালজি দেখবো যে মহাবিশ্ব কি আসলেই অসীম হতে পারে কি না। প্রকৃত পক্ষে কি বিচ্ছিন্ন ভৌত জগতে (Discrete physical world)   অসীম (Actual infinity)  থাকতে পারে? অসীমতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, আনডিফারেন্সিয়েটেড অসীম।অর্থাৎ যা ছোট ছোট অংশে ভাগ করা যায় না। এমন কিছুর অসীমতা। যেমন স্রষ্টার অসীমতা।  অন্য ধরণের অসীমতা হচ্ছে, অসীমতাকে  ভৌত জগতের কিছুর উপর আরোপ করা। যে সকল বস্তুকে ছোট ছোট পার্টে ভাগ করা যায় তাদের উপরে আরোপ করা।  যেমন ধরুন মহাবিশ্বের কোন বস্তুর উপরেই। প্রথম ধরনের অসীমতা থাকা সম্ভব কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের অসীমতা কি সম্ভব? অর্থাৎ প্রকৃত অসীম থাকা কি সম্ভব?

কয়েকটি উদাহরণ দেখা গেলেই বোঝা যাবে যে প্রকৃত অসীম থাকা খুবই অসম্ভব ।

    ★একটি ব্যাগ কল্পনা করুন যাতে অসীম সংখ্যক বল রাখা আছে। এখন যদি আপনি ব্যাগ থেকে দুইটি বল সরিয়ে ফেলেন তাহলে ব্যাগে কয়টি বল থাকবে? গাণিতিকভাবে  এখনো অসীম সংখ্যক বলই ব্যাগে আছে। কিন্তু যা ছিল তার থেকে দুটি কম।এবার যদি আপনি দুটি বল ব্যাগে যোগ করে দেন তাহলে কয়টি বল ব্যাগে থাকবে?যা ছিল তার থেকে দুটি বেশি।মানে অসীম থেকে দুই বেশি? অসম্ভব!  আপনি ব্যাগ থেকে বলগুলো বের  করে গুনে দেখতে পারেন কিন্তু আপনি কখনই অসীম সংখ্যক বল গুনতে পারবেন না। কারণ, অসীম কেবল একটি ধারণা মাত্র। বস্তু জগতে এর কোন অস্তিত্ব নেই।এ জন্যই বিখ্যাত জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট (David Hilbert) বলেছিলেন-

“The infinite is nowhere to be found in reality. It neither exists in nature nor provides a legitimate basis for rational thought….. the role that remains for the infinite to play is solely that of an idea”. [৩]

    ★কিছু কিউবের কথা চিন্তা করুন।প্রথম কিউবটি ১০ কিউব সেন্টিমিটার আয়তনের।এবার এর উপরে এর অর্ধেক আয়তনের একটি কিউব রাখুন। এভাবে আবার দ্বিতীয় কিউবের অর্ধেক আয়তনের আরেকটি কিউব এর উপর রাখুন। এভাবে রাখতে থাকুন। কিউব রাখতে রাখতে অসীম সংখ্যক কিউব রাখুন। এবার সবচেয়ে উপরের কিউবটি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন।  সেখানে কি কোন কিউব আছে? ধরুন আছে এবং আপনি সেটি সরিয়েও ফেললেন।  তাই যদি হয়, মানে সবচেয়ে উপরে যদি একটি কিউব থাকে তাহলে কি দাড়ালো? দাড়ালো কিউবের টাওয়ার কখনোই অসীমে পৌঁছায়নি। আর সবচেয়ে উপরে যদি কোন কিউব না পাওয়া যায় তাহলেও কিউবের টাওয়ারটি কখনই অসীমে পৌঁছাতে পারেনি। এর মানে  discrete physical things কখনোই অসীম হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও ওপরে বলা ব্যাগের বলগুলো আর কিউবগুলো থেকে ভিন্ন কিছু নয়। এই মহাবিশ্ব যৌক্তিকভাবে সসীম আর এর অবশ্যই একটি শুরু থাকতেই হবে।

শূন্য থেকে সৃষ্টিঃ

শূন্য থেকে কি কিছু সৃষ্টি হতে পারে? এর উত্তর আমরা আমাদের ইনটুইসন (intuition)  থেকে কোন দ্বিধা ছাড়াই দিয়ে দিতে পারি- “না”। মেটাফিজিক্যাললি- Being can’t come  from nonbeing. তবে ,এখানে উল্লেখ করা দরকার, পরম শূন্যতা আর কোয়ান্টাম শূন্যতা একই বিষয় নয়। কোয়ান্টাম শূন্যতা কখনই পরম শূন্যতা নয়। কোয়ান্টাম শূন্যতায় ভ্যাকুয়াম এনার্জি থাকে। সুতরাং এটা নাথিং নয় সামথিং।  পরম শূন্যতায় কোন স্থান- কাল, শক্তি এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ – কোন কার্য-কারণ( Cause and effect) থাকবে না। এমন শূন্যতা থেকে কিছু অস্তিত্বে আসা সম্ভব নয়। এরকমটা হলে, যে কোন কিছু যে কেউ দাবি করে বসতে  পারে।যেমনঃ  বিশাল ভবন টুপ করে নাই হয়ে যেতে পারে, হঠাৎ যে কোন কিছু অস্তিত্বে চলে আসতে পারে। ব্যাপারটা কতটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবুন।সুতরাং পরম শূন্যতা, যেখানে কোন causal condition নাই, এমন কিছু থেকে মহাবিশ্ব অস্তিত্বে আসতে পারে না।

নিজেই নিজ থেকেঃ

নিজেই নিজ থেকে কি কিছু অস্তিত্বে আসা সম্ভব?  কোন কিছুকে অস্তিত্বে আসতে হলে তার পেছনে পূর্ব থেকে বিরাজমান একটি কারণ লাগে( pre-existing cause)। ধরা যাক B কে অস্তিত্বে আসতে হলে A কে লাগবে।এখানে A কে অবশ্যই B এর আগে থেকে অস্তিত্বে থাকতে হবে। B নিজেকে নিজে কখনই সৃষ্টি করতে পারবেনা।কারণ, তা করতে হলে B কে আগে থেকেই অস্তিত্বে থাকতে হবে।  আর B যদি আগে থেকেই অস্তিত্বে থেকে থাকে তাহলে তাকে আর অস্তিত্বে আসার দরকার নেই। সুতরাং মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে তৈরি করতে পারবে না।

সৃষ্ট কোন কিছু থেকেঃ

“Every contingent being has a cause.”

 ধরুন মহাবিশ্বের সৃষ্টির জন্য U1 দায়ী। এখন এই U1 নিজেই যদি সৃষ্ট হয়ে থাকে বা “contingent” হয়ে থাকে মানে অন্য কোন সত্তার উপর নিজের অস্তিত্বের জন্য নির্ভর করতে হয়,  ধরা যাক সেই কারণটি হল U2। এবার U2 এরও যদি একই অবস্থা হয় তাহলে এই কজ এন্ড ইফেক্টের চেইন অসীম পর্যন্ত চলতে থাকবে। আর এটা সম্ভব নয়।এটা সম্ভব হলে মহাবিশ্ব কখনই অস্তিত্বে আসতো না।

ব্যাপারটা একটি উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। অনেক সময় তত্ত্ব কথার চেয়ে উদাহরণ আর এনালজি অনেক উপকারী হয়।

    চিন্তা করুন একজন স্নাইপার সুট করার জন্য তার পেছনে এক কমান্ডারের আদেশের অপেক্ষায় আছে। সেই কমান্ডার আবার তার পেছনে দাঁড়ানো অন্য এক কমান্ডারের আদেশের অপেক্ষায় আছে। এর পেছনে আরেক জন। এভাবে চলতে থাকলে অসীম পর্যন্ত কমান্ডারের চেইন চলতে থাকবে( infinite regress)।এর মানে হল ওই স্নাইপার কোন দিনই তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কমান্ডারের আদেশ পাবে না আর গুলিও করতে পারবে না। সুতরাং এই সম্ভাবনাও সম্ভব না।

আল্লাহ্ঃ  বরং তারা বিশ্বাস করে না”

সুতরাং কুরআনের করা এই আর্গুমেন্ট অনুযায়ী মহাবিশ্ব নিঃসন্দেহে আল্লাহর সৃষ্টি। এখানে, এই প্রশ্ন করারো কোন সুযোগ নেই যে- স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো? মনে করুন স্নাইপারের উদাহরণটির কথা। এরকম ভাবলে অসীম পর্যন্ত চেইন চলতেই থাকবে। মহাবিশ্বকে অস্তিত্বে আসতে হলে এক জায়গায় এই কজাল চেইনকে থামতেই হবে যে কজ কন্টিনজেন্ট নয় নেসেসারি। এই প্রশ্ন করারও কোন সুযোগ নেই যে মহাবিশ্ব নিজেই নয় কেন চেইনের সেই শেষ কারণটি? এর উত্তর আগেই দেয়া হয়ে গেছে। মহাবিশ্ব  contingent এবং সসীম concrete being। এটা অসীম কাল থেকে থাকতে পারে না। একে অস্তিত্বে আসতেই হবে।

নোটঃ

[১] কুরআন, সুরা আত্ব-তূর, ৫২:৩৫-৩৬

[২] Bertrand Russell and F.C. Copleston, “The Existence of God,” in The Existence of God, ed. with an Introduction by John Hick, Problems of Philosophy Series (New York: Macmillan & Co., 1964), p. 175.

[৩] David Hilbert. On the Infinite, in Philosophy of Mathematics, ed. with an Intro. by P. Benacerraf and H. Putnam. Prentice-Hall. 1964, page151.

[৪] This argument has been inspired by and adapted from Idris, J. (1994) The Contemporary Physicists and God’s Existence.
.
.
.
.
আল্লাহপাকের অস্তিত্ত্বের ধারনা
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷

মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে হয়ত দেখা যাবে যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রশ্নে যুগে যুগে ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিকদের মনে প্রশ্নের কোন কমতি ছিল না । বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে এই প্রশ্ন এখন অনেকটা মহামারির আকার ধারন করেছে । বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের একদল বিজ্ঞানীরা রীতিমত ধর্মের তথা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্তের বিরুদ্ধে একধরণের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন । বই লেখা থেকে শুরু করে টেলিভিশন, রাস্তার বিলবোর্ড, বিভিন্ন ধরনের প্রচারাভিযান এবং কনফারেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে তারা পুরো শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছেন । যার প্রভাব আমাদের দেশের একদল তরুণদের মাঝেও বিস্তর লাভ করতে সক্ষম হয়েছে । যারফলে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের আবির্ভাবের সাথে সাথে কয়েকটা ব্লগেরও জন্ম হয় । বস্তুতঃ এটা এখন আরেকটি নতুন ধর্মের জন্ম দিয়েছে যার নাম হল নাস্তিক্যবাদ । অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, যারা ধর্ম পালন করেন তাদের বেশীর ভাগই যেমন অনেকটা শুধু বিশ্বাসের অথবা জন্মগত সূত্রের উপর ভিত্তি করেই ধর্মকে পালন করেন তেমনি এই নতুন ধর্ম তথা নাসস্তিক্যবাদে যারা বিশ্বাস করেন তারাও আবেগ এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই করে থাকেন । যাইহোক, আমি কয়েকটি স্তরে ধারাবাহিকভাবে আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ্‌ ।

নাস্তিকদের একটা সাধারণ যুক্তি হল “যা দেখা যায়না তার অস্তিত্ব নেই” । এটাকে অভিজ্ঞতা বাদও বলা হয়ে থাকে । অভিজ্ঞতাই যাবতীয় জ্ঞানের উত্স এই মত অর্থাৎ আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় তথা দেখা, শোনা, স্পর্শ, স্বাদ এবং গন্ধ এর বাইরে জ্ঞানের কোন উৎস নেই । এবং বিজ্ঞানের মূল মন্ত্র হল এই অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) অর্থাৎ সবকিছু হাতে কলমে প্রদর্শনের যে প্রক্রিয়া তাই বিজ্ঞান । কিন্তু আমাদের জীবনে অনেক কিছু আছে যা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব নয় । অর্থাৎ বিজ্ঞান সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এটার সীমাবদ্ধতা আছে এবং কোন কিছুর সত্যতা যাচাই করার জন্য বিজ্ঞানই একমাত্র জ্ঞানের মাপকাঠি না । উদাহরণ স্বরূপ আপনি যে আপনার স্ত্রীকে বা কাউকে ভালবাসেন সেটা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব না । এমনিভাবে রাগ, অনুরাগ এবং যেকোনো নান্দনিকতা ইত্যাদি বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব না । এবার আসুন একটা উদাহরণ দিয়ে “যা দেখা যায়না তার অস্তিত্ব নেই” তত্ত্বটির অসারতা বুঝার চেষ্টা করা যাক । ধরুন আজ আপনি বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে তাড়াহুড়োর কারনে সবকিছু এলোমেলো ভাবে রেখে গেছেন, কোন কিছু গুছিয়ে রেখে যাতে পারেননি । কিন্তু আপনি দিন শেষে ঘরে ফিরে অবাক হয়ে দেখতে পেলেন আপনার ঘর খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো!!! কেউ এসে যে আপনার ঘরকে সাজিয়েছেন সেটা বিশ্বাস করার জন্য কি যে আপনার ঘরকে সাজিয়েছেন তাকে দেখাটা জরুরি? অবশ্যই না? অর্থাৎ না দেখেই সাজানো গোছানো ঘর থেকে আমরা যে ঘরকে সাজিয়াছেন তার অস্তিত্বের প্রমাণ পাই । সুতরাং “যা দেখা যায়না তার অস্তিত্ব নেই” কথাটা যুক্তি সংগত নয় । এ থেকে আমরা আরও বুঝতে পারি যে কোন এলোমেলো জিনিস আপনা আপনি নিজে নিজে সাজানো গুছানো হয়ে যায়না, কাউকে না কাউকে সাজাতে হয় । অর্থাৎ আমরা বিশৃংখলা থেকে আপনা আপনি সুশৃঙ্খলতা দেখতে পাই না । যেমনঃ একটা কাচের গ্লাসকে উপর থেকে ফেলে দিলে আমরা আরও কয়েকটা সুন্দর গ্লাসের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্ভব হতে দেখতে পাইনা বরং গ্লাসটি টুকরো টুকরো হয়ে ভেংগে যেতে দেখি । এটাই স্বাভাবিক এবং এটা একটা সার্বজনীন বিধান যেটা বুঝার জন্য কাউকে পি এইচ ডি করার দরকার হয়না । কিন্তু অভিজ্ঞতাবাদীরা সাধারণত বলে যে “একটা ঘর সাজানো-গোছানো দেখে আপনি ধরে নিচ্ছেন সেটার পেছনে কোনো একজন মানুষ আছে। আপনি কিন্তু ধরে নিচ্ছেন না সেটা কোনো ফেরেসতা বা জ্বীনের কাজ। কিন্তু কেন, কারণ হচ্ছে আপনার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানেন যে এ কাজটা একজন মানুষই করে। আর মানুষ ব্যাপারটি আপনার কাছে পুরোপুরি বোধগম্য । এখন নদী-পাহাড়-পর্বত দেখে ঠিক কেন এর পেছনে ‘ঈশ্বর’ নামক কিছু একটা ভেবে নেবেন?” (সুত্রঃ মুক্তমনা)।

এখানে আমার অভিজ্ঞতাবাদী বন্ধুরা হয়ত যুক্তিটি বুঝতে সক্ষম হননি অথবা বুঝেও না বুঝার ভান করছেন । কারন ঘটনাটা কে বা কিসে ঘটাল সেটা আমার মূল বক্তব্য নয় বরং এখানে মূল বিষয় হল “এটাকে ঘটানো হয়েছে”, ঘটনাটা এমনি এমনি ঘটেনি । এখন কে বা কিসে ঘটিয়েছে সেটা নির্ভর করবে ঘটনাটির ধরণের উপর । ধরুন একটা গাছ বাতাসের ঝাপটায় মাটিতে পড়ে গেল এক্ষেত্রে কারনটা হল বাতাস । আবার গাছটাকে যদি কেটে ফেলা হয় সে ক্ষেত্রে কারনটা হবে মানুষ । So, এখানে মুখ্য বিষয় হল “কারন”, “কে” সেটা নির্ভর করবে ঘটনার প্রকৃতির উপর । ব্যাপারটা আসা করি বুঝে আসছে । হ্যাঁ, আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে যে ঘর সাজানোর কাজটা মানুষের কারন আমরা তা মানুষকেই করতে দেখেছি কিন্তু আপনি কি কখনও আপনার অভিজ্ঞতায় দেখেছেন কোন মানুষকে একটা নক্ষত্র বা একটা গাছ বা একটা মাছি বানাতে? সুস্থ মস্তিস্ক থাকলে অবশ্যই বলবেন না । কিন্তু এসব(নক্ষত্র বা একটা গাছ বা একটা মাছি) বানানোর ঘটনাটাত ঘটেছে । তাহলে আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কমপক্ষে এতটুকু বলতে পারি যে ঘটনাটিকে ঘটান হয়েছে এটা এমনি এমনি ঘটেনি এবং ঘটনার প্রকৃতির উপর নির্ভর করবে কে বা কিসে ঘটনাটি ঘটাতে পারে । আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে যতটুকু জানি তাতে এটা পরিষ্কার যে এটা কোন মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব না । আর এটাও পরিষ্কার যে এটা অতন্ত্য জটিল বা sophisticated। এটা জড় বুদ্ধিহীন কোন জিনিষের কাজ হতে পারে না । সুতরাং যুক্তিসঙ্গত কারনেই এগুলোকে যে ঘটিয়েছে সেই সত্ত্বাও অবশ্যই অসীম জ্ঞানের অধিকারী এবং সেই সত্ত্বার ইচ্ছা শক্তিও থাকতে হবে কারন ইচ্ছা শক্তি আছে বলেই তিনি এগুলো ঘটিয়েছেন । আর এই সত্ত্বাকেই আমরা “ঈশ্বর” বলে থাকি । আসা করি এখন বুঝতে পারছেন ঘঠনার কারনটি যে “সৃষ্টিকর্তা” কোন মানুসনা সেটা কিভাবে বোধগম্য হল, এবং “সৃষ্টিকর্তা” দ্বারা ব্যাখ্যা না করলে আর কোন অর্থবোধক ব্যাখ্যা হতে পারে না । আর সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস কোন অন্ধ বিশ্বাস নয়, এটা একটা যৌক্তিক অবস্থান । নিচে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের কয়েকটি প্রমাণ উল্লেখ করা হলঃ

১। মহাবিশ্বের অতিসূক্ষ্ম সমন্বয়পূর্ণতা

আমরা যদি আমাদের চারপাশে প্রকৃতির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই সবকিছু একটা অতিসূক্ষ্ম সুশৃঙ্খল সমন্বয়পূর্ণ বিধানের মধ্যে আবর্তিত । মহাবিশ্ব তথা সৌরজগৎ, মহাকাশ, চাঁদ, সূর্য, পৃথিবী, গাছপালা ইত্যাদি প্রত্যেকটা জিনিষ একটা শুধু সূক্ষ্ম নয় বরং অতিসূক্ষ্ম সুশৃঙ্খল সমন্বয়পূর্ণ বিধান দ্বারা পরিচালিত । পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব যদি এক ইঞ্চিও বেশী বা কম হত তাহলে এই পৃথিবী বসবাসের উপযোগী হত না । বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ যদি একটু কম বা বেশী হত তাহেলও মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারতনা । অর্থাৎ প্রকৃতির এ সবকিছুই একটা সু নির্দিষ্ট অতিসূক্ষ্ম সুশৃঙ্খল সমন্বয়পূর্ণ বিধানের মধ্যে আবর্তিত । যেহেতু মহাবিশ্বের সবকিছুর মধ্যে আমরা অতিসূক্ষ্ম সুশৃঙ্খল সমন্বয়পূর্ণতা দেখতে পাই সেহেতু আমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে এই অতিসূক্ষ্ম শৃঙ্খলা এল কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদেরকে একটু যুক্তি এবং বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে । আসুন আরেকটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টাকে খোলাসা করা যাক । আপনার হাতের মোবাইল ফোনটাকেই ধরুন । এটা কাচ , পাস্টিক এবং metal বা ধাতু দ্বারা তৈরি । আমরা জানি কাঁচ বালু থেকে আসে, পাস্টিক আসে তেল থেকে আর ধাতু আসে ভূতল থেকে । এখন কল্পনা করুন আপনি কোন এক মরুভূমির পাশ দিয়ে হাঁটছেন যেখানে অনেক তেল, বালি এবং ধাতু পড়ে আছে এবং হঠাৎ আপনি দেখতে পেলেন যে খুব সুন্দর একটা মোবাইল ফোন পরে আছে । আপনি কি ধরেই নিবেন যে মোবাইল ফোনটা নিজে নিজেই তৈরি হয়েছে? অর্থাৎ সূর্যের উত্তাপে বজ্রপাত আর বাতেসের বেগে তেলগুলো বুদবুদ করে উপরে চলে এসে বালি আর ধাতুর সাথে সংমিশ্রিতি হয়ে লক্ষ কোটি বছর পরে এই মোবাইল ফোনটির আবির্ভাব হয়েছে!!! কেউ কি এই ধরনের ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করবে? মোবাইল ফোন এমন একটা জিনিষ যেটাকে স্পষ্টতই কেউ না কেউ পরিকল্পিত চিন্তার দ্বারা ডিজাইন করে একে নির্মিত করেছেন । সুতরাং এটার একজন নির্মাতাও আছে । ঠিক একইভাবে আমরা মহাবিশ্বে যখন সূক্ষ্ম সুশৃঙ্খল সমন্বয় দেখি তখন এর পেছনে একজন সমন্বয় কারী আছে এটা ভাবাইকি যুক্তিসঙ্গত নয়? কিন্তু আমার নাস্তিক যুক্তিবাদী বন্ধুর মনে প্রশ্ন হলঃ “মহাবিশ্বের কোনো এক শৃঙ্খলা যদি ঈশ্বরের প্রমাণ হতে পারে তবে বিশৃঙ্খলা কিসের প্রমাণ হবে?”(সুত্রঃ মুক্তমনা) অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে বিশৃঙ্খলা মানে কোন সৃষ্টিকর্তা নেই! আমি জানিনা নাস্তিকরা এখানে “বিশৃঙ্খলা” দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন । উনারা যেটাই বুঝাতে চান না কেন এতে কোন সমস্যা নেই কারন শৃঙ্খলা বা উনাদের ভাষায় “বিশৃঙ্খলা” যেটাই হোক এসবই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেরই প্রমাণ করে! শৃঙ্খলা বা বিশৃঙ্খলা কোন কিছুই এমনি এমনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সংগঠিত হয়না । কোথাও কি দেখেছেন এমনি এমনি বিশৃঙ্খলা ঘটতে? নাস্তিকদের understanding অনুযায়ী যখন কোন কিছু সাজানো গোছানো দেখবেন ধরে নেবেন এটা কোন মানুষের কাজ যেহেতু অভিজ্ঞতা তাই বলে আর যখন এলোমেলো কিছু দেখবেন তখন এর পেছনে কারন নেই, এটা দৈবক্রমে এমনি এমনি ঘটেছে । যুক্তিবাদির যুক্তি দেখেন!!!

২। মহাবিশ্বের সূত্রপাত

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছু বিজ্ঞানী মনে করেছিলেন আমাদের এই মহাবিশ্ব সর্বদা বিদ্যমান ছিল সুতরাং এর কোন স্রষ্টার প্রয়োজন নেই যেহেতু কোন কিছু যদি সর্বদা বিদ্যমান থাকে তাহলে সেই জিনিষের কোন স্রষ্টা লাগে না । কিন্তু পরবর্তীতে (cosmologists ) মহাবিশ্বতত্ত্ববিদরা আবিষ্কার করল যে আমাদের এই মহাবিশ্বের একটা শুরু হয়েছিল, এর সূত্রপাত হয়েছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে একটা বিশেষ মহাজাগতিক ঘটনার মাধ্যমে যেটাকে মহা বিস্ফোরণ (big-bang) বলা হয় । এবং বিজ্ঞানীদের কাছে এই theory বা তত্ত্বটা সর্বাধিক গৃহীত হয়েছে যেহেতু এই তত্ত্বটা পর্যবেক্ষণযোগ্য । যাইহোক, এখন আসাযাক এই তত্ত্বের তথা এই মহা বিস্ফোরণ (big-bang) এর মূল বিষয়ে । এই তত্ত্বের মূল সারমর্ম হল; এই মহাবিশ্ব তথা আমাদের সৌরজগৎ, চাঁদ, অগণিত তারা, সূর্য, ধুমকেতু এসবই প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে একটা ছোট পিণ্ডের মত ছিল এবং সেই অবস্থায় একদিন হঠাৎ একটা মহাবিস্ফোরণ বা big bang হয় এবং এই মহাবিস্ফোরণের পর আমাদের এই সৌরজগৎ সহ এই মহাবিশ্বের আবির্ভাব হয়! এবার ভেবে দেখুনতো, আপনি আপনার ড্রয়িংরুমে বসে আছেন আর হঠাৎ করে পাশের ঘর থেকে একটা বিকট আওয়াজ শুনতে পেলেন । হৎচকিয়ে আপনি পাশে বসে থাকা আপনার ছোট ভাইকে বললেন “কি হয়েছে দেখত” । সে পাশের ঘর থেকে ঘুরে এসে বলল “কিছুই হয়নি, ওঘরে কেউ নেই এমনি এমনি কোন কারন ছাড়াই একটা বিকট শব্দ হয়েছে” শুধু তাইনা সে আরও বলল যে “বিকট আওয়াজের পর ঘরের যাকিছু ছিল সবকিছু সাজানো গুছানো এবং নতুন হয়ে গেছে” । আপনি আপনার ভাইকে কি বলবেন বা করবেন সেটা আপনার উপরই ছেড়ে দিলাম । কিন্তু আপনি অবশ্যই তার কথা কক্ষনোই বিশ্বাস করবেন না । কারন আপনি জানেন যে কোন কারণ ছাড়া এমনি এমনি কোন কিছু ঘটেনা । আপনি নিজেকে প্রশ্ন করবেন কে বা কিসে এই বিকট শব্দটি ঘটাল? এর পিছনে উদ্দেশ্যটা কি? আরও নানা রকম প্রশ্নের উদ্রেক হওয়াটাই খুবই স্বাভাবিক । ঠিক এই একই যুক্তিতে আমরা বলতে পারি মহা বিস্ফোরণ (big-bang) এরও অবশ্যই একটা কারন আছে তথা কেউ না কেউ এটাকে ঘটিয়েছে, এটা এমনি এমনি ঘটেনি । আপনার ছোট ঘরের মধ্যে যদি এমনি এমনি কিছু ঘটতে না পারে তাহলে মহাবিশ্বের মহাবিস্ফোরণ এমনি এমনি ঘটারতো কোন কারন থাকার কথা না । এবং যে ঘটিয়েছে তাকে অবশ্যই খুবই প্রজ্ঞাময়ি এবং বিচক্ষন হতে হবে । কারন কোন সৃষ্টি যত জটিল এর সৃষ্টি কর্তাও তত বেশী বিচক্ষন হয় । মহাবিশ্বের চেয়ে জটিল সৃষ্টি আর কি হতে পারে? সুতরাং এর সৃষ্টি কর্তাকেও মহা প্রজ্ঞাময় হতে হবে, বরং তার প্রজ্ঞা আমাদের ধারনার সীমানার বাইরে ।

একটি প্রশ্নের জবাবঃ সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছেন?

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি নাস্তিকরা উপরোল্লিখিত এই যুক্তিটা খণ্ডন করতে পারে না কিন্তু এই যুক্তির উপর ভিত্তি করে পাল্টা আরেকটা যুক্তি পেশ করে । তারা জিজ্ঞাসা করে যে ঠিক আছে যদি সবকিছুরই সৃষ্টি কর্তা থাকে তাহলে সৃষ্টি কর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে? হুম, আমি তাদেরকে প্রশ্ন করি একটু ভেবে বলুনতো আমি কোথায় বলেছি যে “সবকিছুরই একটা সৃষ্টিকর্তা আছে”? আমি কখনোই বলি না যে “সবকিছুরই একটা সৃষ্টিকর্তা আছে” বরং সবকিছুই যেটার অস্তিত্বের শুরু আছে সেটারই একটা সৃষ্টিকর্তা আছে । শুরিতেই বলেছিলাম “মহাবিশ্বের একটা শুরু হয়েছিল” সুতরাং এটারও একটা সৃষ্টিকর্তা আছে । যাইহোক, কিন্তু নাস্তিকের মাথা থেকে এটা কোন ভাবেই যাচ্ছে না যে সৃষ্টকর্তা কিভাবে এল, তার অস্তিত্বের শুরু কিভাবে হল? আমি বলি সৃষ্টিকর্তার কোন সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে না আর সৃষ্টিকর্তার কোন শুরুও থাকা সম্ভব না । কারন তাহলে একটা যৌক্তিক অসম্ভাবনার সৃষ্টি হবে । আসুন একাটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করা যাক । ধরুন আপনি র‍্যাবের একজন চৌকস সৈনিক এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অপারেশনে একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসীকে ধরার জন্য বেড়িয়েছেন । অপারেশনের কোন এক পর্যায়ে আপনারা যাকে খুঁজছেন তাকে আপনি বন্দুক হাতে যেতে দেখলেন । এখন আপনার হাতেও এ কে ৪৭ প্রস্তুত কিন্তু গুলি চালাবার আগে আপনাকে আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট হতে অনুমতি নিতে হবে । সংগে সংগে আপনি আপনার পেছনে দাড়িয়ে থাকা আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট অনুমতির জন্য জিজ্ঞাসা করলেন “স্যার, দেই গুলি করে, ক্রস ফায়ার বলে চালিয়ে দেব”? । কিন্তু আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আপনাকে বললেন যে “অপেক্ষা কর আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আসি” । তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট অনুমতি চাওয়ার পর সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একই কথা বললেন “অপেক্ষা কর আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে আসি” । এখন এই পরিস্থিতি যদি অসীমভাবে চলতে থাকে তাহলে আপনি কি আদৌও আপনার ওই টার্গেটকে গুলি করতে পারবেন? কখনোই না । আপনি আপনার টার্গেটকে তখনই গুলি করতে পারবেন কেবলমাত্র কেউ যদি আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে এমন থাকে যার আর কারো কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নাই, যিনি self sufficient; আত্বনির্ভর স্বয়ংসম্পূর্ণ । এখন আমরা যদি বলি যে সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি করেছেন আরেক সৃষ্টিকর্তা এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন আরেক সৃষ্টিকর্তা এবং এভাবে যদি অনন্তকাল যেতে থাকি তাহলে সৃষ্টিকার্যই শুরু হবে না ঠিক র‍্যাবের সেই সৈনিকের মত কিন্তু সৃষ্টিজগত বিদ্যমান! (এটাকে গণিতবিদরা বলে (infinite regress) “অসীম পশ্চাদগমন” যেটা একটা যৌক্তিক অসম্ভাবনার জন্ম দেয় । আর বিজ্ঞানীদের নিকট “অসীম রাশি” বলতে কিছু নেই কারন এটা পর্যবেক্ষণ যোগ্য নয় এটা একটা কাল্পনিক রাশি । যেমন; অসীম রাশি থেকে কিছু যোগ বা বিয়োগ করলে অসীম রাশিই থাকে এর কোন পরিবর্তন হয়না )। সুতরাং এই যুক্তির আলোকে, সৃষ্টিজগত থেকে এটা স্পষ্টত প্রমানিত যে সৃষ্টিকর্তা একজনই এবং সৃষ্টিকর্তার কোন সৃষ্টিকর্তা থাকা সম্ভব নয় । আর এই সৃষ্টিকর্তা চিরন্তন, অনন্ত, কালাতীত এবং মহাজগতের বাইরে তথা সৃষ্টির বাইরে যেহেতু এসবই তার সৃষ্টি ।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিঃ

ক) সবকিছু যেটার অস্তিত্বের একটি শুরু আছে সেটার শুরুর পেছনে একটি কারণ/উৎস(cause) আছে। –

খ) মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে। সুতরাং:

গ) মহাবিশ্বের একটি কারণ/উৎস (cause) আছে।

এই কারণ/উৎস (cause) হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা কারণ জড় বা জ্ঞানহীন কোন কিছু এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির কারণ হতে পারে না । এই মডেলটি ভুল প্রমাণ করতে হলে আপনাকে ক) এবং খ) কে ভুল প্রমাণ করতে হবে । অর্থাৎ আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে কোন কোন জিনিষের অস্তিত্বের শুরু কোন কারন ছাড়াই হয়ে থাকে অর্থাৎ এমনি এমনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়ে থাকে । যেমন ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন আর হঠাৎ করে একটা মুরগির ডিম অথবা একটা গাড়ি বা এরকম যে কোন কিছু আপনার সামনে এসে হাজির হল!!! উল্লেখ্য যে আমি এটা বলছিনা যে সবকিছুর পেছনে একটা কারন আছে বরং যে জিনিসের অস্তিত্তের শুরু আছে সেই জিনিসেরই একটা কারন আছে ।

৩। বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধ

নাস্তিকদের বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছু নেই তাহলে আমার প্রশ্নঃ কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ সেটা নির্ধারণ করবে কে? ভাল মন্দের সংজ্ঞাই বা কি? আপনার মতে হয়ত কিছু কাজ ভাল এবং এর দ্বারা আপনার মানসিক শান্তি উপলব্ধি হয় । কিন্তু আরেকজনের কাছে হয়ত ঠিক এর বিপরীত তথা আপনার দৃষ্টিতে যেগুলো খারাপ কাজ সেগুলো করে শান্তি পায় । আপনি তাকে মন্দ ব্যাক্তিও বলতে পারবেন না যেহেতু সৃষ্টিকর্তার অনুপস্থিতিতে আমরা কারো অধিনে না, আমরা সবাই একেকটা স্বাধীন জীব, আমরা যেভাবে খুশি সেভাবে চলতে পারি । নাস্তিকরাও তাই বলে যে “কোন ছকে বাঁধা মতবাদ অনুসরন করতেই হবে এর কোন মানে নেই” । (সুত্রঃ মুক্তমনা)

এখানে আমার এই প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হল যে কারো কাছে যদি চূড়ান্ত জবাবদিহিতা করতে না হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে আমি বা আপনি কেউই ভাল মন্দের সংজ্ঞা নিরুপন করতে পারবনা । অর্থাৎ করো কাছে জবাবদিহিতা না থাকলে আমরা সার্বজনীন বস্তুগত ভাল বা মন্দ (absolute good বা bad) অথবা সার্বজনীন বস্তুগত সত্য বা মিথ্যা (absolute/objective truth বা false) কি তা কখনোই নির্ধারণ করতে পারব না এবং যার ফলাফল হত ভয়াবহ । কিন্তু আমরা জানি যে সার্বজনীন বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধ (absolute good বা bad) অথবা সার্বজনীন বস্তুগত সত্য বা মিথ্যার (absolute/objective truth বা false) অস্তিত্ব আছে । যেমন ধরুন ধর্ষণ করা যে মন্দ কাজ এটা সার্বজনীন এমনকি ধর্ষণকারীর কাছেও এটা খারাপ কাজ কারন সেও কখনও তার নিজের মা বা বোনকে কেউ ধর্ষণ করুক এটা কখনই চাইবে না । এখন প্রশ্ন হল এই চূড়ান্ত জবাবদিহিতা করবেন কার কাছে? এই চূড়ান্ত জবাবদিহিতা হতে হবে সৃষ্টিকর্তার কাছে । কেন? কারন সৃষ্টি কর্তা ছাড়া জবাবদিহিতার প্রশ্নই আসেনা । কারন তখন আমি ধরে নেব যে আমি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আকস্মিকভাবে সৃষ্ট অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় একটা জীব যেটা এমনি এমনি ঘঠেছে, আমার জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই কোন মানে নেই এবং মৃত্যর মধ্য দিয়ে আমি একদিন এই প্রক্রিয়ার মাঝে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব । সুতরাং যতদিন বেচে থাকব ততদিন আমি শুধু আমার আরাম আয়েস, সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি নিয়েই মশগুল থাকব যেহেতু মৃত্যর পর আর কিছু নেই। অন্যের কি হল বা না হল সেটা আমার কাছে কোন বিষয় না । আমার কাছে চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, লুন্ঠন কোন খারাপ কাজ না । কিন্তু বাস্তবে আমরা তা দেখিনা । আর ঠিক এই কারনেই বর্তমান সময়ের অক্সফোর্ডের একজন বড় মাপের নাস্ত্যিক যার নাম জে এল ম্যাকি তার দি মিরাকল অফ থিয়িজম (The Miracle of Theism) নামক বইয়ের ১১৫-১১৬ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেনঃ
“If, then, there are such intrinsically prescriptive objective values, they make the existence of a god more probable than it would have been without them. Thus we have, after all, a defensible inductive argument from morality to the existence of a god” আমার রাফ অনুবাদ “যদি এরকম প্রকৃত প্রচলিত বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধ থেকে থাকে তাহলে সেটা সৃষ্টি কর্তার অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দেয় । সুতরাং, অবশেষে আমরা বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধের দ্বারা সৃষ্টি কর্তার অস্তিত্বের একটা inductive যুক্তি পেলাম” । অর্থাৎ বড় বড় নাস্তিকরাও স্বীকার করেন যে বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধের দ্বারা সৃষ্টি কর্তার অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায় ।

সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিঃ

ক। যদি সৃষ্টি কর্তার অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধের অস্তিত্ব থাকত না

খ। বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধের অস্তিত্ব আছে

গ। সুতরাং, সৃষ্টি কর্তার অস্তিত্বও আছে ।

এখানে খেয়াল করার বিষয় হল যে আমি এটা বলছিনা যে নৈতিক জীবন যাপনের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস করতে হবে । আমি এটাও বলছিনা যে সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস না করলে আমরা বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধ কি তা সনাক্ত করতে পারবনা । আমার প্রশ্ন হল সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ব্যাতিত বস্তুগত নৈতিক মুল্যবোধের অস্তিত্ব কি থাকতে পারে? অবশ্যই না । যদি বলি হ্যাঁ তাহলে কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ সেটা নির্ধারণ করবে কে? ভাল মন্দের সংজ্ঞাই বা কি?

শায়খ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ আল উসাইমিন  (رحمه الله تعالى)  আকিদার বই “আল আকিদা আল ওয়াসিতিয়া” এর ব্যাখায় বলেনঃ

قلناالدليل على وجود اللهالعقل، والحس، والشرع.

যদি কেউ প্রশ্ন করে যে- আল্লাহর অস্তিত্তের প্রমাণ কি? আমরা বলি আল্লাহর অস্তিত্তের প্রমাণ হল তিনটি-
১। العقل – আকল(intellect) বা বোধশক্তি
২। الحس – ইন্দ্রিয় (senses) 
৩। الشرع – শারিয়া ।

এই তিনটাই আল্লাহর অস্তিত্তের প্রমাণ করে । এর সাথে আরেকটা যোগ করা যেতে পারে সেটা হল الْفِطْرَةِ ফিতরাৎ (innate disposition)  সহজাত বা অন্তর্জাত প্রবণতা ।

অর্থাৎ তাহলে আল্লাহর অস্তিত্তের প্রমাণ হল চারটি- 
১। العقل – আকল(intellect) বা বোধশক্তি
২। الحس – ইন্দ্রিয় (senses) 
৩। ফিতরাৎ(innate disposition)  সহজাত বা অন্তর্জাত প্রবণতা 
৪। الشرع – শারিয়া ।

আমরা এখানে শারিয়াকে চার নম্বরে উল্লেখ করেছি এর মানে এই না যে এটা প্রথমে উল্লেখ করার মত এতটা গুরুত্তপূর্ণ নয় বরং এটা এ কারনে যে যাদেরকে এখানে সম্বোধন করা হচ্ছে তারা শারিয়াকে বিশ্বাস করেনা । 

আকল (intellect) বা বোধশক্তির প্রমান প্রসঙ্গে আমরা জিজ্ঞেস করিঃ সমস্ত প্রাণীগুলো কি নিজেদের দ্বারাই  অস্তিমান/বিদ্যমান নাকি এটা দৈব ঘটনা(by chance)? যদি আপনি বলেন যে এরা নিজেরা নিজেদের দ্বারাই  অস্তিমান/বিদ্যমান, তাহলে এটা যুক্তিযুক্তভাবে  অসম্ভব । কারনঃ প্রথমে এটার কোন অস্তিত্তই ছিল না- সুতরাং এটা অস্তিমান হল কি করে?- যখন এটার কোন অস্তিত্তই ছিল না?

অস্তিত্বহীনতা হল কিছু না/ শূন্য (nothing) যতক্ষন পর্যন্ত না এটা অস্তিমান হয় এবং কোন কিছু সক্রিয়ভাবে নিজেকে অস্তিমান করতে পারেনা। আপনি যদি বলেন যে এটা দৈব ঘটনা(by chance), আমরা বলি এটাও অসম্ভব! সকল সৃষ্ট জিনিস যেমন- প্লেইন, রকেট, যানবাহন এবং বিভিন্ন রকমের যন্ত্রপাতি এগুলো কি দৈব ঘটনার(by chance) ফসল? আপনি অবশ্যই বলবেন এটা কোন দৈব ঘটনার(by chance) ফসল না । এটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে একই যুক্তিতে ,যে কিছুই হউক না কেন, পাখি, পাহাড়, সূর্য, চন্দ্র, তারা, গাছগাছালি, সমুদ্র এবং অন্যান্য সকল জিনিস এগুলোও দৈব ঘটনার(by chance) ফলে অস্তিমান হতে পারেনা ।

এটা বলা হয় যে আস-সুমানিয়ার একদল লোক, যারা ইন্ডিয়ার অধিবাসী, ইমাম আবু হানিফার(রহঃ) কাছে এসেছিলেন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্তের বিষয়ে  বিতর্ক (debate) করার জন্য এবং তারা তাঁর সাথে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্তের বিষয়ে  বিতর্ক করেন ।

ইমাম আবু হানিফা(রহঃ), যিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান, মেধাবী এবং বিচক্ষণ ছিলেন, তাদের সাথে সাক্ষাতের একটা সময় নির্ধারণ করলেন । এবং তাদেরকে দুইদিন পরে আসতে বললেন ।

তারা দুইদিন পর এসে তাঁকে জিজ্ঞাস করলেনঃ আপনার কি বলার আছে?

ইমাম আবু হানিফা(রহঃ) বললেনঃ আমি একটা মাল বোঝাই করা জাহাজের কথা চিন্তা করছিলাম যেটা সমুদ্রের মধ্যে যাত্রা শুরু করল তারপর জাহাজ ঘাটে পৌছাল, তারপর মাল খালাস করল তারপর জাহাজটি আবার চলে গেল কিন্তু জাহাজটিতে কোন ক্যাপ্টেন এবং কোন শ্রমিক ছিল না ।

তারা বললঃ আপনি আসলেই এটা ভেবেছেন? তিনি উত্তর দিলেনঃ হ্যাঁ ।

তখন তারা বললঃ আপনার কোন বুদ্ধিই নেই! এটা কি কল্পনা করা যায় যে এটা জাহাজ নিজে নিজেই কোন ক্যাপ্টেন ছাড়াই সমুদ্রের মাঝে চলবে এবং  মাল খালাস করে চলে যাবে?  এটা বোধগম্য নয়!

আবু হানিফার(রহঃ) বললেনঃ এটা কেমন যে তোমরা এটা উপলব্ধি করতে পারছনা অথচ তোমরা মনে কর যে আকাশ, সূর্য, চন্দ্র, তারা, পাহাড়, গাছ গাছালি, জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি সবই কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়াই সৃজিত অস্তিমান হয়েছে? তারা কোন উত্তর দিতে পারেনি ।

একবার এক বেদুঈন আরবকে জিজ্ঞেস করা হলঃ কিসের দ্বারা তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ত সম্পর্কে জান?

সে উত্তর দিলঃ পদ চিহ্ন সফরের দিক নির্দেশনার ইঙ্গিত  দেয় । গোবর ইঙ্গিত দেয় উটের । সুতরাং আকাশ, পৃথিবীর সুন্দর পথঘাট, সমুদ্রের ঢেউ ইন্ত্যাদি- এগুলো কি একজন সৃষ্টিকর্তার ইঙ্গিত বহন করেনা?

এই সবকিছুর সারসংক্ষেপ আল্লাহ কুরআনের মধ্যে সূরা আত্ব তূরে এভাবে উল্লেখ করেছেনঃ

৩৫.) কোন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এরা কি আপনা-আপনিই সৃজিত হয়ে গেছে? না কি এরা নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টিকর্তা?

৩৬.) না কি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলএরাই সৃষ্টি করেছে? প্রকৃত ব্যাপার হলো, তারা বিশ্বাস পোষণ করে না । 
.
.
.
.
আল্লাহপাকের অস্তিত্বর অকাট্র প্রমান
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
.
শুরুর কথা

আপনি যেখানে বসে এ-লেখাটি পড়ছেন, তার চারপাশে চট্ করে একবার চোখ বুলিয়ে নিন। আপনার আশপাশের সবকিছুই কি সৃষ্ট (made) নয়? চেয়ার, টেবিল, ঘরের ছাদ, দেয়াল, মেঝের কার্পেট—অনেক কিছুই রয়ে গেছে আপনার চারপাশে। এগুলোর একটিও হঠাৎ করে এমনি এমনি বা দৈবাৎ (by chance)অস্তিত্বলাভ করেনি; না এগুলো নিজেরা নিজেদের সৃষ্টি করেছে। রাজমিস্ত্রি ঘরের দেয়াল তুলেছে, কাঠমিস্ত্রি বানিয়েছে চেয়ার-টেবিল, মেঝের কার্পেটের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে অনেকের শ্রম।
ভাবুন সে-পাঠকের কথা, যিনি এইমাত্র একটি বই হাতে নিয়ে পড়বার জন্য বসেছেন। তিনি জানেন যে, বইটি কোনো একজন লেখক, কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন। তিনি কি ভুলেও এ-কথা মনে করবেন যে, বইটি কোনো একজন লেখকের দ্বারা নয়, বরং এমনি এমনি রচিত হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই না। একটি চমৎকার ভাস্কর্য দেখে আপনি কি সংশ্লিষ্ট ভাস্করকে, মনে মনে হলেও, প্রশংসা করবেন না? ভাস্কর্যটি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে—এমন অবাস্তব চিন্তা আপনার মাথায় আসবে-ই না। যদি কোনো ব্যক্তি বলে যে, লোহা ও কয়লা আপনা-আপনিই বা দৈবাৎ একত্রিত হয়ে স্টিল তৈরী করেছে এবং সে-স্টিল আপনা-আপনিই বা দৈবাৎ সৃষ্টি করেছে আইফেল টাওয়ার (Eiffel Tower), তবে কি সে-ব্যক্তিকে লোকে পাগল বলবে না?
এখন দেখুন, আল্লাহ্র অস্তিত্বকে অস্বীকারকারীদের অন্যতম হাতিয়ার বিবর্তনবাদ কী বলছে। এ-তত্ত্ব অনুসারে: অজৈব অনু (inorganic molecules) থেকে দৈবাৎ এমিনো এসিড (amino acids) গঠিত হয়েছে ; এমিনো এসিড থেকে দৈবাৎ গঠিত হয়েছে প্রোটিন (proteins); এবং সবশেষে প্রোটিন থেকে দৈবাৎ (আবারো?) গঠিত হয়েছে জীবিত প্রাণী! অথচ,  দৈবাৎ জীবিত প্রাণীর অস্তিত্বলাভ করবার সম্ভাবনা, দৈবাৎ আইফেল টাওয়ারের অস্তিত্বলাভের সম্ভাবনার চাইতে অনেক কম!! কারণ, যে-কোনো সরলতম জীবকোষও পৃথিবীর যে-কোনো মনুষ্যসৃষ্ট জিনিসের চাইতে জটিলতর।
এবার আমাদের এ-বিশ্বজগতের কথা খানিকক্ষণ ভাবুন। প্রকৃতির সর্বত্র বিরাজ করছে ভারসাম্য আর শৃক্সক্ষলা। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজগতের কোথাও কোনো খুঁত নেই। সবকিছু চলছে নিয়মের অধীনে। এই অসম্ভব নিখুঁত বিশ্বজগত এমনি এমনি বা দৈবাৎ সৃষ্টি হয়েছে ভাবা কি পাগলামী নয়? বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তু যেখানে একজন স্রষ্টার
অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে, সেখানে এ-বিশ্বজগত নিজেকে নিজে সৃষ্টি করেছে বলে দাবী করাও চরমভাবে অযৌক্তিক একটি কাজ।
তাহলে ধরে নিতেই হচ্ছে যে, বিশ্বজগতের একজন স্রষ্টা আছেন। কিন্তু কে তিনি—যিনি নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন কল্পনার চেয়ে বিশাল এ-বিশ্বজগত এবং গোটা বিশ্বজগতকে করেছেন ভারসাম্যপূর্ণ? তিনি আমাদের এ-বিশ্বজগতের কেউ হতে পারেন না; কারণ, এ-বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বেও তাঁর পবিত্র সত্ত্বার অস্তিত্ব ছিল। সর্বশক্তিমান স্রষ্টা হচ্ছেন সেই একক সত্ত্বা—যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, অথচ তাঁর নিজের কোনো শুরু বা শেষ নেই।
ধর্ম আমাদেরকে তাঁর পবিত্র সত্ত্বা সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং আমরা আমাদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে তাঁর অস্তিত্ব আবিস্কার করি। তাঁর কাছ-থেকে-আসা ধর্মের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্—যিনি পরম করুণাময় এবং দয়ালু। ধর্ম আমাদের আরো শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ্ আসমান এবং পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন শূন্য থেকে।
কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চায়। তাঁরা একটি সুন্দর পেইন্টিং দেখে এর পেইন্টার সম্পর্কে জানতে তো আগ্রহী হয়; অথচ প্রকৃতির যে অপার সৌন্দর্য ওই শিল্পকর্মের উপজীব্য, সেই প্রকৃতির স্রষ্টার অস্তিত্ব তাঁরা অবলীলায় করে অস্বীকার। তাঁরা পেইন্টারের শিল্পকর্মের জন্য তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেও, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য যিনি সৃষ্টি করেছেন—সেই মহান স্রষ্টার প্রশংসা করা তো দূরের কথা, তাঁর অস্তিত্বই স্বীকার করে না। অথচ, মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব উপলব্ধি করবার জন্য কোনো জটিল বা দীর্ঘমেয়াদী গবেষণা করবার প্রয়োজন নেই। আমাদের চারপাশে  ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আল্লাহ্র অস্তিত্বের অসংখ্য প্রমাণ। আমাদের মানবদেহের কথা-ই ধরুন। মানবদেহ সম্পর্কে কয়েক মিনিট গভীরভাবে চিন্তা করুন; দেখবেন, এই অত্যাশ্চর্য ‘মেশিনটির’ যে একজন স্রষ্টা আছেন—সে-সম্পর্কে আপনার বিবেক সাক্ষ্য দেবে।
মানবদেহই এক্ষেত্রে চিন্তার একমাত্র খোরাক নয়। আমরা দেখি বা না-দেখি, পৃথিবীর সর্বত্র জীবনের ছড়াছড়ি। এককোষী জীব থেকে শুরু করে উদ্ভিদজগত, কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে সামুদ্রিক প্রাণী, এবং পাখী থেকে শুরু করে মানুষ—পৃথিবী পূর্ণ হয়ে আছে অগুনতি জীবন দ্বারা। একমুঠো মাটি নিয়ে গভীরভাবে তাকান, দেখবেন, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কতো বিচিত্র প্রাণের ছড়াছড়ি সেখানেও! ওই একই কথা খাটে বাতাসের ক্ষেত্রেও। জীবন ধারনের জন্য যে-বাতাস বুকের মধ্যে টেনে নেয়া ছাড়া আপনার কোনো গত্যন্তর নেই—সেই বাতাসেও ভেসে বেড়াচ্ছে কতো বিচিত্র সব প্রাণ!! আপনার ত্বকের কথাই ধরুন। কতো অসংখ্য জীবিত সৃষ্টিই না সেখানে দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছে। ওদের নামও আপনি জানেন না, না আপনি ওদের খালি চোখে দেখতে পারেন। সকল জীবিত প্রাণীর অন্ত্রে (intestines) বাস করে লক্ষ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া বা এককোষী জীব। এরা হজমে সাহায্য করে। পৃথিবীতে যতো মানুষ আছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আছে পশু-পাখি। যদি আমরা উদ্ভিদজগতের কথাও বিবেচনা করি, তখন দেখি যে, পৃথিবীর সর্বত্র জীবনের ছড়াছড়ি। এই যে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কোটি কোটি জীব—এদের প্রত্যেকের আছে আলাদা আলাদা বডি-সিস্টেম; এদের জীবনধারণ-পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন এবং পৃথিবীর প্রতিবেশগত ভারসাম্য (ecological balance) রক্ষায় প্রতিনিয়ত এরা পালন করে যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এহেন কোটি কোটি জীব দৈবক্রমে সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং এ-সৃষ্টির পেছনে কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল নেই—এমনটি দাবী করা কি নিতান্তই অযৌক্তিক নয়? বস্তুত, কোনো জীব নিজেকে নিজে সৃষ্টি করেনি বা নিজের প্রচেষ্টার ফলে অস্তিত্বে আসেনি। জীবনের মতো একটি জটিল জিনিস দৈবক্রমে সৃষ্টি হয়েছে বলে ভাবাও অসম্ভব। তাহলে?
আসলে এ-সব কিছুই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এ-বিশাল সৃষ্টিজগতের সৃষ্টির পেছনে আছে একজন মহান স্রষ্টার হাত। সৃষ্টিজগতের সবকিছু আমাদের এ-উপসংহারে পৌঁছুতে বাধ্য করে যে, এ-বিশ্বজগতে যা-কিছু প্রতিনিয়ত ঘটছে—তা এমনি এমনি ঘটছে না, বরং এ-সবই হচ্ছে একধরনের সচেতনতার (consciousness) বহিঃপ্রকাশ। প্রশ্ন হচ্ছে: এ-সচেতনতার উৎস কী? কে এ-সব সৃষ্টি করেছে এবং সবকিছু নিয়মমাফিক পরিচালনা করছে? নিশ্চিতভাবেই বলা চলে যে, এ-সৃষ্টজগতের কোনো জীব বা জড় পদার্থ সে-উৎস নয়। এরা তো নিজেরাই সৃষ্ট, সৃষ্টি করবে কীভাবে? কীভাবেই বা এ-বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষায় এরা সমর্থ হতে পারে? কেউ যখন এভাবে চিন্তা-গবেষণা করতে শুরু করে, তখন এ-বিশ্বজগতের মধ্যেই সে খুঁজে পায় এক মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের অসংখ্য প্রমাণ; তার অন্তর মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে হয় নিশ্চিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এরপরও কেউ কেউ এই প্রমাণগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এ-প্রসঙ্গে কুরআন বলছে: “…যুলুম ও ঔদ্ধত্যের কারণে তারা তা মানতে অস্বীকার করে, যদিও তাদের অন্তর (এ-সত্যকে) গ্রহণ করে নিয়েছিল…”–(সুরা আন-নামল; আয়াত-১৪)।
প্রিয় পাঠক! এ-পুস্তকাটি লেখা হয়েছে মূলত আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কিত সে-সব বাস্তবতাকে চিহ্নিত করবার জন্যে—যে বাস্তবতা থেকে একশ্রেণীর লোক এ-কারণে চোখ ফিরিয়ে নেয় যে, এগুলো তাদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এতে সংশ্লিষ্ট এমন অনেক চিন্তা-ভাবনা ও তত্ত্বের অসারত্ব প্রমাণ করা হয়েছে—যেসব চিন্তা-ভাবনা ও তত্ত্ব একজন স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে উৎসাহিত করে। মোদ্দাকথা, বইটিতে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বইটি যারা মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, তারা আরো একবার এ-বিশ্বজগতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন অসংখ্য প্রমাণের সাক্ষাৎ পাবেন যা একজন মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করছে প্রতিনিয়ত। বস্তুত, সৃষ্টজগতের সবকিছুর মধ্যে আছে একজন মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ। যারা যুক্তির ভাষা বোঝেন, তাদের পক্ষে এ-কথা মেনে নেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই যে, সেই স্রষ্টা এই বিশ্বজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং সবকিছুকে পরিচালিত করছেন সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে।

শূন্য থেকে সৃষ্টি বা অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আসা
এ-বিশ্বজগত কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এ-বিশ্বজগতের চূড়ান্ত পরিণতি কী? কীভাবেইবা  এর শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য বজায় থাকবার জন্য দায়ী  প্রাকৃতিক নিয়মগুলো কাজ করছে? এ-প্রশ্নগুলো সকল কালের সকল মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। কৌতুহল-উদ্দীপক এ-সব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তাদের সে-সব চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে বেশকিছু তত্ত্বের বা থিওরির।
বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টি সম্পর্কে যে-সব চিন্তা-ভাবনা মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে ছিলো—সেগুলোর সারমর্ম হচ্ছে: এ-বিশ্বজগত অসীম, এটি অনাদিকাল থেকেই অস্তিত্বশীল আছে, এবং এটি অনন্তকাল অস্তিত্বশীল থাকবে। এ-তত্ত্বের নাম হচ্ছে ‘স্থির বিশ্ব মডেল’ (`static universe model’)এবং এ-তত্ত্ব অনুসারে, এ-বিশ্বজগতের কোনো শুরু বা শেষ নেই।
বস্তুত, বস্তুবাদী দর্শনের মূল ভিত্তিই হচ্ছে এ-তত্ত্ব। এ-তত্ত্ব স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে। এ-তত্ত্ব অনুসারে, এ-বিশ্বজগত হচ্ছে বস্তুর সমাহার এবং এখানে বস্তুর কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন ঘটে না।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বস্তবাদী দর্শনে(materialism) বস্তুকে পরম সত্ত্বা (absolute being) বলে মনে করা হয় এবং বস্তু ছাড়া অন্য কোনো কিছুর (স্রষ্টাসহ) অস্তিত্বকে করা হয় অস্বীকার।
এ-বস্তুবাদী দর্শনের জন্ম প্রাচীন গ্রীসে। গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এ-দর্শন ক্রমবর্ধমানহারে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। বিশেষ করে, কার্ল মার্কস-এর দ্বান্দিক বস্তুবাদের (dialectical materialism) আদলে এ-দর্শন ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে।
যেমনটি আগে উল্লেখ করেছি, ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘স্থির বিশ্ব মডেল’ বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছিল। বস্তুবাদ ও মার্কসবাদ-এর গোড়া সমর্থক ছিলেন জর্জ পলিটজার (George Politzer)। তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে লিখেছিলেন Principes Fondamentaux de Philosophie (The Fundamental Principles of Philosophy) নামক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। তিনি তার সে-গ্রন্থে ‘স্থির বিশ্ব মডেল’-কে সমর্থন করে বলেন যে, এ-বিশ্বজগত কোনো একজন স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট হয়নি। তিনি আরো লিখেছেন: “ এটি ( অর্থাৎ এ-বিশ্বজগত) সৃষ্ট হলে, অবশ্যই একে শূণ্য থেকে তাৎক্ষণিকভাবে একজন স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট হতে হতো। সৃষ্টির ধারণা মেনে নিতে হলে এ-কথাও মেনে নিতে হয় যে, এমন একটা সময় ছিলো যখন বিশ্বজগতের অস্তিত্ব ছিলো না এবং আরো মেনে নিতে হয় যে, শূন্য থেকে কোনো কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব। অথচ এটি এমন এক কথা—যা বিজ্ঞান মেনে নিতে পারে না।”-( দেখুন, পৃষ্ঠা-৮৪)।
পলিটজার দাবী করেছিলেন যে, শূন্য থেকে এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়নি। আর এ-দাবী তিনি করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘স্থির বিশ্ব মডেল’-এর ওপর নির্ভর করে। তিনি তখন ভেবেছিলেন যে, তার দাবীটি বিজ্ঞানভিত্তিক এবং যথার্থ। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখা গেল যে, বিজ্ঞান পলিটজারের দাবীর পক্ষে নেই। বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ‘স্থির বিশ্ব মডেল’-এর মতো তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করলো। আজ, এই একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এসে, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, আমাদের এ-বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিলো এবং এটি সৃষ্টি হয়েছিলো একটা প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের মাধ্যমে।
বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিলো—এর অর্থ এ-বিশ্বজগত শূন্য থেকে অস্তিত্বলাভ করেছে। অন্যভাবে বললে, এ-বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। একসময় অস্তিত্ব ছিলো না, অথচ এখন আছে—এমন একটা বস্তুর বর্তমান অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, এর একজন স্রষ্টা আছেন। হ্যা, এ-কথা ঠিক যে, অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা বা শূন্য থেকে সৃষ্টির বিষয়টি মানুষের পক্ষে উপলব্দি করা অসম্ভব (মানুষের পক্ষে বাস্তবে এটা উপলব্দি করা এ-কারণে অসম্ভব যে, মানুষের জন্য এ-বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের কোনো সুযোগ নেই)। শূন্য থেকে কোনো কিছু সৃষ্টি করা আর একাধিক বস্তুর সমন্বয়ে বা সাহায্যে অন্য একটি নতুন জিনিস সৃষ্টি করা (যেমন: এরোপ্লেন,  মোনা লিসা, ওয়ার এন্ড পিস ইত্যাদি) মোটেই এক কথা নয়। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা মানুষ হর-হামেশাই অর্জন করছে। কিন্তু প্রথমধরনের অভিজ্ঞতা অর্থাৎ শূন্য থেকে সৃষ্টির  অভিজ্ঞতা মানুষের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। এটা স্রষ্টার এক কুদরত যে, তিনি একটা বিশেষ মুহূর্তে বিশ্বজগতের সবকিছু একসঙ্গে সৃষ্টি করেছেন, নিখুঁতভাবে। অথচ একসময় বিশ্বজগতের কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি, তখন কাল ও স্থানেরও (time and space) অস্তিত্ব ছিলো না—যে কাল ও স্থানে কোনো কিছু সৃষ্টি করা যায়!
এ-বিশ্বজগত যে একজন স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে, তার সম্ভাব্য সবচে বড় প্রমাণ হচ্ছে, এটি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে বা অন্যভাবে বললে, এটি শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ-সত্য মানুষের চিন্তার জগতে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। এ-সত্য মানুষকে জীবনের অর্থ উপলব্দি করতে সাহায্য করে এবং জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করতে এবং জীবনের লক্ষ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এ-জন্যই সম্ভবত বিজ্ঞানীদের কোনো কোনো মহল সৃষ্টিসংক্রান্ত সত্যকে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত হয়েছেন, যদিও সৃষ্টি ও স্রষ্টা সম্পর্কিত প্রমাণাদি তাদের কাছেও কম স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়নি। বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ যতোই একজন স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, ততোই যেন তাঁরা নিত্য-নতুন তত্ত্ব হাজির করে প্রমাণ করবার প্রয়াস পাচ্ছেন যে, একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব আদপেই নেই। এ-কাজে তাঁরা খুব একটা সফলকাম হতে না-পারলেও, অনেক মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছেন সফলতার সঙ্গেই। যা হোক, বিজ্ঞানের তথ্য-প্রমাণ কিন্তু এ-ধরনের সকল তত্ত্বকেই চূড়ান্তভাবে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে।
এখন আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবো সে-প্রক্রিয়া নিয়ে—যে প্রক্রিয়ায় এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়েছে। বলা বাহুল্য, আধুনিক বিজ্ঞান এ-ব্যাপারে আমাদের সামনে যে-সব তথ্য-প্রমাণ মেলে ধরছে, এখানে সে-সবই হবে আমাদের আলোচনার নিয়ামক।

বিশ্বজগতের সম্প্রসারণ (The expansion of the universe)

১৯২৯ সালের কথা। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল(Edwin Huble) তখন কাজ করছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে (California Mount Wilson observatory)। সে-সময় তিনি তার বিশাল টেলিস্কোপ দিয়ে তারকা (stars)পর্যবেক্ষণ করতে করতে আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম চমকপ্রদ সত্যকে। সত্যটি হচ্ছে: তারকাগুলো ক্রমশ পৃথিবীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তারকাগুলো যে-আলো উৎপাদন করে, পৃথিবী থেকে সে-আলোর গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে হাবল এ-সত্য আবিষ্কার করেন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে এডউইন হাবল আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, তারকাগুলো শুধু পৃথিবী থেকেই ক্রমাগতভাবে দূরে সরে যাচ্ছে তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে এরা পরস্পরের কাছ থেকেও ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সহজভাবে বললে, আমরা এমন এক বিশ্বজগতে বাস করছি, যেখানে গ্রহ-নক্ষত্রসহ সবকিছু একে অপরের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এ-সত্য আবিষ্কৃত হবার পর, বিজ্ঞানীদের সামনে এ-সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না যে, আমাদের এ-বিশ্বজগত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের এ-বিশ্বজগত হচ্ছে ক্রমশ সম্প্রসারণশীল এক বিশ্ব (expanding universe)

আমাদের এই সম্প্রসারণশীল বিশ্বকে বুঝবার জন্য একটি বেলুনের উদাহরণ দেয়া যায়। একটা বেলুন হাতে নিয়ে—ভেতরে বাতাস দিয়ে ফোলানোর পূর্বে—বলপেন দিয়ে এর গায়ে বেশ কয়েকটি ফোটা দিন। তারপর ধীরে ধীরে বেলুনটা ফোলাতে শুরু করুন। কী লক্ষ্য করছেন? বেলুনটা ক্রমশ ফুলছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বেলুনের গায়ের ফোটাগুলো ক্রমশ একটার কাছ থেকে আরেকটা দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের এই বিশ্বজগতও বেলুনের মতো ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এর গ্রহ-নক্ষত্রগুলো একে অপরের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বেলুনকে যদি অনন্তকাল পর্যন্ত ফোলানো যেতো, তবে ঠিক আমাদের বিশ্বজগতের মতোই হতো তার অবস্থা!
সত্যি বলতে কি, আমাদের এ-বিশ্বজগত যে ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে—এ সত্য আরো আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিলো। আর এ-আবিষ্কার করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী  আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা (theoretical physics) নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি হিসেব-নিকেশ করে মনে মনে এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আমাদের এ-বিশ্বজগত স্থির (static) হতে পারে না। তার সময়ে বিশ্বজুড়ে ‘স্থির বিশ্ব মডেল’-ই ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো। আইনস্টাইন ওই বহুল প্রচলিত তত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তার নতুন তত্ত্ব সাধারণ্যে প্রচার করা থেকে বিরত থাকবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী কালে অবশ্য আলবার্ট আইনস্টাইন তার সে-সিদ্ধান্তকে জীবনের সবচে বড় ভুল (the greatest mistake of his career)হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত এডউইন হাবল-এর পর্যবেক্ষণ থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্বজগত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং ‘স্থির বিশ্ব মডেল’-এর কোনো ভিত্তি নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে: বিশ্বজগত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে—এ সত্যের সঙ্গে এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টির সম্পর্ক কী?
বিশ্বজগত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে মানে, এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টির সূচনা হয়েছিলো একটি একক পয়েন্ট থেকে (from a single point)। বিজ্ঞানীরা হিসেব-নিকেশ করে দেখিয়েছেন যে, ওই একক পয়েন্টের বা বিন্দুর আয়তন ছিল শূন্য (zero volume) এবং ঘণত্ব (density) ছিলো অসীম (infinite)। বিজ্ঞানীরা আরো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ওই শূন্য আয়তন ও অসীম ঘণত্বের একক পয়েন্ট-এ এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই বিশ্বজগত (এবং অতি অবশ্যই আমাদের এ-পৃথিবীও)। বিজ্ঞানীদের এ-সব হিসেব-নিকেশ জন্ম দেয় বিশ্বজগত সৃষ্টি সম্পর্কিত এক নতুন তত্ত্বের। তত্ত্বটির নাম ‘মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্ব’(Big Bang Theory)
এখানে বলে রাখা ভালো যে, ‘শূন্য আয়তন’ বাzero volume হচ্ছে বর্ণনার সুবিধার্থে ব্যবহৃত একটি তাত্ত্বিক প্রকাশ (theoretical expression)। শূন্যকে (nothingness) উপলব্ধি করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। বিজ্ঞান ‘শূন্য’-কে প্রকাশ করতে যে-শব্দগুচ্ছকে ব্যবহার করে তা হচ্ছে: ‘শূন্য আয়তনবিশিষ্ট একটা পয়েন্ট’ (a point with zero volume)। সত্য হচ্ছে, ‘শূন্য আয়তনবিশিষ্ট একটা পয়েন্ট’ বলতে ‘শূন্য’-কেই বোঝায়। অর্থাৎ এ-বিশ্বজগত অস্তিত্ব লাভ করেছে শূন্য থেকে। অন্যভাবে বললে, এ-বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্ব অনুসারে, শুরুতে এ-বিশ্বজগতের সকল বস্তু একসঙ্গে ছিলো এবং মহা-বিস্ফোরণের ফলে বস্তগুলো একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। আগ্রহ-উদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, এ-সত্য আল-কুরআনে প্রকাশ করা হয়েছিলো চৌদ্দশত বছর পূর্বেই। আর সকলেই জানেন যে, চৌদ্দশত বছর পূর্বে এ-বিশ্বজগত সম্পর্কে মানুষ জানতো খুবই কম! আসুন দেখি কুরআন এ-ব্যাপারে কী বলছে:

“অবিশ্বাসীরা কি লক্ষ্য করে না যে, আসমানসমূহ ও পৃথিবী (এক সময়) ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিলো? অতপর আমরাই এদেরকে আলাদা করে দিয়েছি এবং প্রাণবান সবকিছুই সৃষ্টি করেছি পানি থেকে। তবুও কি তাঁরা বিশ্বাস করবে না?”-( সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত-৩০)।

কুরআনের ওই আয়াত থেকে এটা ষ্পষ্ট যে, সবকিছু সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল একটি একক পয়েন্ট থেকে। একক পয়েন্টে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলেই কেবল একসঙ্গে থাকা বিভিন্ন বস্তু দ্রুত একে অপরের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে শুরু করতে পারে। কুরআনের বক্তব্য থেকে এটাও স্পষ্ট যে, শুরুতে তো আসমানসমূহ ও পৃথিবী একসঙ্গে থাকায় আলাদাভাবে আসমান তথা গ্রহ-নক্ষত্রসমূহ ও পৃথিবীর কোনো আলাদা আকার-আকৃতি ছিলো না। একক পয়েন্টে বিস্ফোরণের পর ধীরে ধীরে গ্রহ-নক্ষত্রসমূহ ও পৃথিবী আলাদা আলাদা আকার-আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভুত হয়।
এখন কুরআনের ওই আয়াতটির বক্তব্যের সঙ্গে যদি আমরা ‘মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্বের’ তুলনা করি, তবে দেখবো যে, কুরআনের বক্তব্য ও আলোচ্য তত্ত্বের বক্তব্যের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, বরং আছে মিল-মিছিল। পার্থক্য অবশ্য আছে একটা: কুরআনের বক্তব্য চৌদ্দশত বছর আগের এবং মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্বের জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীতে!
আমাদের এ-বিশ্বজগত যে শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে—তার প্রমাণ হিসেবে অনেক তথ্য পেশ করা যায়। তবে, বিশ্বজগত ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে—এ তথ্যই সবচে বড় প্রমাণ যে, বিশ্বজগত শূন্য থেকে সৃষ্ট। বিজ্ঞান এ-সত্য আবিষ্কার করেছে মাত্র সেদিন—ঊনবিংশ শতাব্দীতে। কিন্তু স্রষ্টা বা আল্লাহ আমাদের কাছে এ-সত্য প্রকাশ করেছেন চৌদ্দশত বছর আগে অবতীর্ন আসমানী গ্রন্থ আল কুরআনে:
“আমরাই (অর্থাৎ আল্লাহ) আমাদের ক্ষমতাবলে এ-বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছি এবং আমরাই একে সম্প্রসারিত করে চলেছি।”–(সুরা আয যারিরাত, আয়াত-৪৭)।

‘মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্ব’ বা বিগ ব্যাং থিওরির বিকল্প সন্ধানে দেখা যাচ্ছে, মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্বের মাধ্যমে এটা প্রমাণ করা যায় যে, এ-বিশ্বজগত শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। অন্যভাবে বললে, এ-বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন একজন মহান স্রষ্টা (অর্থাৎ আল্লাহ)। স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি বস্তুবাদী দর্শনের ধারক-বাহক অনেক জ্যোতির্বিদের। কারণ, তাদের ‘বিশ্বাসের’—এ-বিশ্বজগত অনাদিকাল থেকে অস্তিত্বশীল আছে এবং এটি কেউ সৃষ্টি করেনি—মূল ভিত্তিই নাড়িয়ে দিয়েছিল বিগ ব্যাং তত্ত্ব। তাই তাঁরা মহা-বিস্ফোরণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে নেমে পড়লো। বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিরুদ্ধে বস্তুবাদী পন্ডিতদের মাঠে নেমে পড়বার কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে বস্তুবাদী পদার্থবিদ আর্থার এডিংটনের(Arthur Eddington) বক্তব্য থেকে। তিনি বলছেন: “বর্তমানে আমরা যে-প্রকৃতি দেখছি, সেটি একসময় আকষ্মিকভাবে অস্তিত্বলাভ করতে শুরু করেছিল—এ ধারণা আমার কাছে ফিলসফিক্যালি (Philosophically) গ্রহণযোগ্য নয়।”–[দেখুন:Jaki,S. (1980) Cosmos and Creator]
বিগ ব্যাং তত্ত্ব যাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল, স্যার ফ্রেড হয়েল (Sir Fred Hoyle) তাদের অন্যতম। তিনি বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বিগ ব্যাং-এর একটি বিকল্প তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তার সে-তত্ত্বের নাম ‘দ্য স্টেডি-স্ট্যাট থিওরি’ (the steady-state theory)। ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘স্থির বা অপরিবর্তনীয় বিশ্ব’ তত্ত্বের সঙ্গে স্যার ফ্রেড হয়েলের তত্ত্বের মিল আছে। তিনি তার তত্ত্বের মাধ্যমে দাবী করেন যে, এ-বিশ্বজগত আয়তনের দিক দিয়ে যেমন অসীম, তেমনি এর অস্তিত্বের সময়কালও অসীম। বলা বাহুল্য, স্যার হয়েল তত্ত্বটি দাঁড় করিয়েছিলেন বস্তুবাদী দর্শনকে সমর্থন করবার লক্ষ্য নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই, স্যার হয়েলের তত্ত্ব বিগ ব্যাং তত্ত্বের সঙ্গে পুরোপুরিভাবেই ছিল সাংঘর্ষিক। কারণ, বিগ ব্যাং তত্ত্ব বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিল বলে রায় দেয়।
স্যার ফ্রেড হয়েলের তত্ত্বের সমর্থকরা বছরের পর বছর ধরে বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিরুদ্ধাচরণ করে আসছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞান কিন্তু তাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কাজ করছিলো।
১৯৪৮ সালে, জর্জ গামভ (George Gamov) বিগ ব্যাং তত্ত্বসংশ্লিষ্ট একটি নতুন ধারণা পেশ করেন। তিনি বলেন যে, যদি একটি আকষ্মিক ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে এ-বিশ্বজগত অস্তিত্বলাভ করে থাকে, তবে সে-বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট বিচ্ছুরিত বস্তু বা রেডিয়েশান (radiation) সুনির্দিষ্ট মাত্রায় থেকে যাবার কথা। তিনি আরো বলেন যে, সম্ভাব্য সে-রেডিয়েশান খুঁজে বের করতে পারার কথা এবং সে-ধরণের রেডিয়েশান (যদি থাকে) বিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে থাকবার কথা।

আরো প্রমাণ: কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান (cosmic background radiation)

জর্জ গামভ তার ধারণা পেশ করবার বেশ কয়েক বছর পর, ১৯৬৫ সালে, আরনো পেনজিয়াস (Arno Penzias) ও রবার্ট উইলসন(Robert Wilson) নামক দুজন গবেষক মহাশূন্যে একধরণের বিচ্ছুরিত বস্তু বা রেডিয়েশানের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। ‘কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশান’ নামক এ-রেডিয়েশান কোনো একটা নির্দিষ্ট উৎস থেকে বিচ্ছুরিত না-হয়ে বরং গোটা মহাশূন্যজুড়ে ছড়িয়ে আছে বলেই মনে হচ্ছিল। অল্পকিছুকালের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করলেন যে, এ-রেডিয়েশান বিশ্বজগত সৃষ্টির শুরুতে যে-বিস্ফোরণ হয়েছিলো—সে-বিস্ফোরণের প্রতিফল(echo) বৈ আর কিছু নয়। এ-আবিষ্কারের জন্য পেনজিয়াস ও উইলসন নোবেল পুরষ্কার পান।
কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশানের ওপর গবেষণা করবার জন্য, ১৯৮৯ সালে নাসা (NASA) মহাশূন্যে প্রেরণ করে ‘কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার’ (Cosmic Background Explorer বা সংক্ষেপে COBE) নামক একটি স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটের অতি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন ও ষ্পর্শকাতর যন্ত্রপাতিগুলো মাত্র আট মিনিট সময় নিয়েছিলো মহাশূন্যে পেনজিয়াস ও উইলসন কর্তৃক আবিষ্কৃত রেডিয়েশানের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে। সহজ করে বললে, বিশ্বজগতের সৃষ্টির শুরুতে যে-বিস্ফোরণ ঘটেছিলো—তার অবশিষ্ট(remains) খুঁজে পেয়েছিলো ওই কোবে (COBE) স্যাটেলাইট।

পেনজিয়াস ও উইলসনের পর্যবেক্ষণ ও কোবে স্যাটেলাইট কর্তৃক সে-পর্যবেক্ষণের সত্যতা প্রমাণের ঘটনাকে গণ্য করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হিসেবে। এ-আবিষ্কারের ফলাফল সুস্পষ্টভাবেই বিগ ব্যাং তত্ত্বকে সত্য বলে প্রমাণ করে। কোবে স্যাটেলাইটের পর কোবে-২ (COBE 2) স্যাটেলাইট মহাশূন্যে পাঠানো হয়েছিলো এবং কোবে-২ স্যাটেলাইটের পাঠানো তথ্যসমূহও বিগ ব্যাং তত্ত্বের ভিত্তিতে করা হিসেব-নিকেশকে সত্য বলে প্রমাণ করে।
বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে আরো প্রমাণাদি অপেক্ষা করছিলো। যেমন, বিশ্বজগতে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের নির্দিষ্ট পরিমাণ ও এই গ্যাসদুটোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক (হাইড্রোজেন গ্যাস পুড়ে হিলিয়াম গ্যাস হয়) প্রমাণ করে যে, বিশ্বজগত সৃষ্টিসংক্রান্ত বিগ ব্যাং তত্ত্ব সঠিক এবং অন্যদিকে স্যার ফ্রেড হয়েলের ‘দ্য স্টেডি-স্ট্যাট থিওরি’ (the steady-state theory) ভুল। এক্ষেত্রে হিসেবটা সহজ: যদি হয়েলের তত্ত্ব অনুসারে বিশ্বজগত অনাদি কাল থেকে অস্তিত্বশীল হতো এবং সত্যিসত্যি এর কোনো শুরু না-থাকতো, তবে এ-বিশ্বজগতের সকল হাইড্রোজেন গ্যাস ইতোমধ্যেই পুড়ে হিলিয়াম গ্যাসে পরিণত হয়ে যাবার কথা (যা বাস্তবে হয়নি)।

এ-ধরনের সুষ্পষ্ট ও আকাট্য প্রমাণের ফলে, বিজ্ঞানীরা বাধ্য হয়েছেন বিগ ব্যাং তত্ত্বকে সঠিক বলে মেনে নিতে। বস্তুত, আমাদের এ-বিশ্বজগতের শুরু ও সৃষ্টির ব্যাপারে যে-তত্ত্বটিকে বিজ্ঞান এখনো পর্যন্ত সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করে, সেটি হচ্ছে বিগ ব্যাং মডেল।

স্যার ফ্রেড হয়েলের তত্ত্বকে দীর্ঘকাল ধরে সমর্থন করেছেন বিজ্ঞানী ডেনিস সিয়ামা (Dennis Sciama)। কিন্তু বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণাদি আবিষ্কারের পর তিনি লিখেছেন:
“স্টেডি স্ট্যাট তত্ত্বের সত্যাসত্যতা নিরূপণের লক্ষ্যে যে-সব বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন—আমার ধারণা তাঁরা কাজ করছিলেন তত্ত্বটিকে মিথ্যা প্রমাণ করবার আশা নিয়েই—তাঁরা একসময় তত্ত্বটির বিভিন্ন দিক নিয়ে তীব্রভাবে সমালোচনামুখর হয়ে উঠলেন। তত্ত্বটির একজন সমর্থক ছিলাম বিধায়, তখন আমি খুব একটা উচ্চবাচ্য করিনি। আমি তত্ত্বটির সমর্থক ছিলাম—এ কথার অর্থ এই নয় যে, আমি তত্ত্বটিকে সঠিক বলে বিশ্বাস করতাম। আসলে, আমার কাছে তত্ত্বটিকে বেশ চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছিল এবং আমি মনে মনে চাইতাম যেন এটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়। অবশেষে যখন তত্ত্বটির বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণগত প্রমাণাদি পাওয়া যেতে লাগলো, তখন সেসব প্রমাণের বিরুদ্ধে প্রতিপ্রমাণ দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ফ্রেড হয়েল। সে সময় তত্ত্বটির (স্টেডি স্ট্যাট তত্ত্ব) পক্ষে আমারও ক্ষুদ্র একটা ভূমিকা ছিল এবং কীভাবে তত্ত্বটির বিরুদ্ধ-প্রমাণের বিরোধীতা করা যায়—সে বিষয়ে আমি কিছু সাজেশান দেয়ারও চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু স্টেডি স্ট্যাট তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রমাণের পর প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত এটা ষ্পষ্ট থেকে ষ্পষ্টতর হয়ে উঠলো যে, সব আশা শেষ এবং স্টেডি স্ট্যাট তত্ত্বকে পরিত্যাগ করা ভিন্ন আর কোনো গতি নেই।”–( দেখুন: Stephen Hawking, A Brief History of Time: A Reader’s Companion, edited by Gene Stone, 1993, p.63)

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of California)প্রফেসর জর্জ এবেল (Prof. George Abel) কী বলছেন শুনুন। তিনি বলছেন যে, বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা ষ্পষ্টভাবেই প্রতিয়মান হয় যে, কোটি কোটি বছর আগে একটা প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের মাধ্যমেই এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বিগ ব্যাংগ থিওরিকে গ্রহণ করে নেয়া ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিজয়ের ফলে,  ‘অনাদি বস্তু’-র ধারণা—যা কিনা বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি—নিক্ষিপ্ত হলো ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিলো? এক মহা-বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই অনস্তিত্বশীল বিশ্বজগতকে অস্তিত্বে আনলো যে শক্তি—সে-শক্তিটাই বা কী? এ-ধরনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই মেনে নিতে হয় একজন স্রষ্টার অস্তিত্বকে, বস্তুবাদীদের পক্ষে তা মেনে নেয়া ‘ফিলোসফিক্যালি’ যতোই কঠিন হোক না কেন।

এ-বিষয়ে বিখ্যাত নাস্তিক দার্শনিক এন্থনি ফ্লিউ-এর(Anthony Flew) বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন:
“স্বীকারোক্তি আত্মার জন্য ভালো বলে কুখ্যাতি আছে। আমি স্বীকার করছি যে, সৃষ্টিতত্ত্সংক্রান্ত সমকালীন সর্বসম্মত মত নাস্তিকদের ভালোরকম বিব্রত করবে। কারণ, বিশ্বজগতের একটা শুরু ছিল—এ ধারণাটা ফিলোসফিক্যালি প্রমাণ করা সম্ভব হবে না বলে সেন্ট থমাসের (St. Thomas) মতো কেউ কেউ বিশ্বাস করলেও, দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টিতত্ত্ববিদরা এ-ধারণার সপক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ঠিকই পেশ করছেন।…(বিশ্বজগতের কোনো শুরু বা শেষ নেই—এ কথা) যদিও আমি এখনো সঠিক বলেই বিশ্বাস করি, তথাপি বলতেই হচ্ছে যে, বিগ ব্যাং তত্ত্বের উপস্থিতিতে ওই বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকা সহজ ও স্বস্তিদায়ক ব্যাপার নয় মোটেও ।”–(দেখুন: Henry Margenau and Roy Abraham Varghese, eds, Cosmos, Bios, Theos, La Salle, IL, Open Court Publishing, 1992, p.241)

বস্তুত, অন্ধভাবে নাস্তিক থেকে যাবার পণ করে বসেননি—এমন অনেক বিজ্ঞানীই একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। না তাঁরা এ-বিশ্বজগত সৃষ্টিতে একজন সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ভূমিকাকে অস্বীকার করেন। তাঁরা বলেন যে, এই স্রষ্টা অবশ্যই এমন এক সত্ত্বা—যে সময় (time) ও বস্তুর(matter) প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন থেকে ও-দুটোকে সৃষ্টি করেছে।

নভোবস্তুবিদ্যাবিদ (astrophysicist) হিউজ রস (Hugh Ross) এ-প্রসঙ্গে বলছেন:
“ মহাশূন্য-উপপাদ্য (space-theoremঅনুসারে, আমাদের এ-বিশ্বজগত ও সময়-এর (time) সৃষ্টির সূচনা হয়েছিলো একসঙ্গে। যদি তাই হয়, তবে এ-বিশ্বজগত সৃষ্টির পেছনে এমন এক সত্ত্বা ‘কারণ’ হিসেবে বিরাজ করছে—যে কিনা আমাদের এ-বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বেও অস্তিত্বশীল ছিল এবং যে আমাদের এ-বিশ্বজগতের ‘সময়-মাত্রা’ (time-dimensionথেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও ভিন্ন একটি সময-মাত্রায় বসে কাজ করে যাচ্ছে। স্রষ্টা কী এবং কী নয়—এ ব্যাপারে আমাদের উপলব্ধির জন্য ওই সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের বলে যে, স্রষ্টা নিজে এ-বিশ্বজগত নন, না তিনি এ-বিশ্বজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো স্বত্ত্বা (…God is not the universe itself, nor is God contained within the universe.)।”–(দেখুন: Hugh Ross, Ph.D., The Creator and the Cosmos, Navpress, 1995, p.76)

বস্তুত, বস্তু (matter) ও সময় (time) সৃষ্টি করেছেন সর্বশক্তিমান স্রষ্টা—যিনি বস্তু ও সময়-এর অধীন নন। এ-স্রষ্টাই হচ্ছেন আল্লাহ—যিনি আসমানসমূহ ও পৃথিবীর মালিক।

মহাশূন্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য (Delicate Balances in Space)

নাস্তিক দার্শনিক এন্থনি ফ্লিউ-এর স্বীকারোক্তি নিঃসন্দেহে বস্তবাদীদের বিব্রত করেছে। কিন্তু, সত্যি বলতে কি, বিগ ব্যাং তত্ত্ব বস্তুবাদীদের বিব্রত করেছে তারচে অনেক বেশি। কারণ, বিগ ব্যাং তত্ত্ব শুধু এ-কথা বলছে না যে, এ-বিশ্বজগত শূন্য থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে; এ-তত্ত্ব এ-সত্যও তুলে ধরছে যে, এ-বিশ্বজগতকে অস্তিত্বে আনা হয়েছে সুপরিকল্পিত, নিয়মতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণ ঘটেছিলো যে-পয়েন্টে—সে পয়েন্টে জমা ছিল এ-বিশ্বজগতের সকল বস্তু ও শক্তি। মহা-বিস্ফোরণের পর-পরই, বিশ্বজগতের সকল বস্তু ও শক্তি মহাশূন্যে ছিটকে পড়েছিলো প্রচণ্ড গতিতে। ছিটকে-পড়া ওসব বস্তু ও শক্তি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অগুণতি গ্যালাক্সি ও তারকা; সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবী, সূর্য ও অন্যান্য আসমানী বস্তু। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে যে, সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজ করছে চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা। তা ছাড়া, বিজ্ঞানীরা পদার্থবিদ্যার যে-সব সূত্র বা নিয়ম (laws of physics)আবিষ্কার করেছেন—সে-সব সূত্র বা নিয়মও বিশ্বজগতের সবকিছুর জন্যেই সমভাবে প্রযোজ্য এবং এ-নিয়মগুলো অপরিবর্তিতও রয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রমাণিত হচ্ছে যে, মহা-বিস্ফোরণের পর, বিশ্বজগতে একটা অনবদ্ধ বা পারফেক্ট ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থারও উদ্ভব ঘটেছে।

আগ্রহ-উদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, কোনো বিস্ফোরণই শৃঙ্খলার উদ্ভব ঘটায় না। আমরা যে-ধরণের বিস্ফোরণ দেখে অভ্যস্ত—সে সব বিস্ফোরণ তো শুধু ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলাই ডেকে আনে। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ কী ধরণের ধ্বংস ও ক্ষতির কারণ—তা পৃথিবীবাসী জানে। হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, প্রাকৃতিক গ্যাসের বিস্ফোরণ—সবধরণের বিস্ফোরণের ফলাফলই হচ্ছে ধ্বংস আর বিশৃঙ্খলা।
যদি আমাদের সামনে এমন কোনো বিস্ফোরণ ঘটে—যা কিনা ধ্বংসের পরিবর্তে সৃষ্টি করে, বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে শৃঙ্খলা আনে, তবে আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? ধরা যাক, মাটির নীচে এক বিস্ফোরণ ঘটলো এবং তা থেকে সৃষ্টি হলো অপূর্ব সৃষ্টিকর্ম, বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা বা রাজপ্রাসাদ। আমরা একে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো? নিশ্চয়ই আমরা এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হবো যে, এ-বিস্ফোরণের পেছনে কোনো অতিপ্রাকৃতিক (super-natural)শক্তির হাত আছে—যে শক্তি, বিস্ফোরণের পর, বিক্ষিপ্ত বস্তুসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করেছে দক্ষ হাতে!

প্রশ্ন হচ্ছে: বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণের ব্যাপারেও কেন আমরা একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবো না?

স্যার ফ্রেড হয়েল দীর্ঘকাল বিগ ব্যাং তত্ত্বের বিরোধীতা করেছেন (শেষপর্যন্ত অবশ্য নিজের ভুল স্বীকার করেছিলেন তিনি)। বিগ ব্যাং সম্পর্কে দেয়া তার একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
তিনি বলছেন:
“বিগ ব্যাং তত্ত্ব বলে যে, এ-বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে। …বিস্ফোরণ কেবল সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিগ ব্যাং-এর ফলে ঠিক উল্টো ঘটনাই ঘটেছে। রহস্যজনকভাবে বিগ ব্যাং-এর পর সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহ পরস্পরের সঙ্গে মিলে-মিশে অসংখ্য গ্যালাক্সি সৃষ্টি করেছে।”–(দেখুন: W.R.Bird, The Origin of Species Revisited, Nashville: Thomas Nelson, 1991; originally published by Philosophical Library in 1987, p.462)

স্যার ফ্রেড হয়েল বিগ ব্যাং তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করছিলেন বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এবং ধরে নিয়েছিলেন যে, বিগ ব্যাং ছিল একটি ‘অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ’ (‘uncontrolled explosion’)। অর্থাৎ একদিকে তিনি স্বীকার করছেন যে, বিস্ফোরণের মাধ্যমে কোনো কিছু সৃষ্টি হওয়াটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, বরং ‘রহস্যজনক’ বিষয়; আবার অন্যদিকে তিনি দাবী করেছেন যে, বিগ ব্যাং ছিল ‘অনিয়ন্ত্রিত’ একটি বিষয়—যার পেছনে কোনো স্রষ্টার হাত ছিল না। বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে সৃষ্টির বিষয়টিকে মেনে নেয়া এবং পাশাপাশি এ-দাবী করা যে, বিগ ব্যাং একটি কাকতালীয় ব্যাপার বৈ কিছু নয়—এ কি পরস্পরবিরোধী কথা নয়? আসলে একজন স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করবার জন্যই স্যার ফ্রেড অমন পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করছিলেন। যদি এটা সত্য বলে ধরে নেয়া হয় যে, একটি মহা-বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই সুশৃঙ্খল বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, তবে সেই মহা-বিস্ফোরণকে ‘অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ’ বলবার পরিবর্তে বরং ‘অসাধারণভাবে নিয়ন্ত্রিত’ বিস্ফোরণ বলাই সংগত এবং যুক্তিযুক্ত।
বিগ ব্যাং-এর পর আমাদের এ-বিশ্বজগতে অসাধারণ শৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিগ ব্যাং-এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে একটি ‘বাসযোগ্য বিশ্বজগত’-এর (‘habitable universe’)। একটি বাসযোগ্য বিশ্বজগত সৃষ্টির ব্যাপারটা এতো জটিল এবং এতো অসংখ্য পূর্বশর্তসংশ্লিষ্ট যে, তেমন একটি বাসযোগ্য বিশ্বজগত এমনি এমনি দৈবক্রমে সৃষ্টি হয়ে গেছে বলে চিন্তা করা রীতিমতো অসম্ভব।
সুবিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ পল ডেভিস (Paul Davies), বিগ ব্যাং-এর পর বিশ্বজগত যে-গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে—তা নিয়ে হিসেব-নিকেশ করে একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। পল ডেভিসের হিসেব অনুসারে, বিগ ব্যাং-এর পর বিশ্বজগত যে-গতিতে সম্প্রসারিত হওয়া শুরু করে—সে গতি ছিল একদম পারফেক্ট! তার হিসেব মতে, যদি ওই গতিবেগ কোটি কোটি ভাগের একভাগও কমবেশি হতো, তবে আজকের ‘বাসযোগ্য বিশ্বজগত’-এর মতো কোনো মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতো না!! এ-প্রসঙ্গে পল ডেভিস কী বলছেন শুনুন:
“সূক্ষ্মভাবে হিসেব-নিকেশ করে দেখা যাচ্ছে যে, বিগ ব্যাং-এর পর বিশ্বজগতের সম্প্রসারণের গতির মাত্রা ছিল ঠিক ততোটুকু—যে মাত্রায় সম্প্রসারিত হওয়া শুরু করলে বিশ্বজগত তার নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ-শক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়ে অনন্তকালের জন্য সুশৃঙ্খলভাবে সম্প্রসারিত হতে পারে। সম্প্রসারণের গতিবেগ সামান্যতম কম হলে, এ-বিশ্বজগত ধ্বংস হয়ে যেত; আবার গতিবেগ সামান্যতম বেশি হলেও, বিশ্বজগতের সবকিছু বহু আগেই বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত। …স্পষ্টতই বিগ ব্যাং কোনো সাধারণ বিস্ফোরণ ছিল না, ছিল সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত একটি বিশাল বিস্ফোরণ।”-(দেখুন: W.R.Bird, The Origin of Species Revisited, Nashville: Thomas Nelson, 1991; originally published by Philosophical Library in 1987, p.405-406)

বিগ ব্যাং-এর সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যার যে-সব সূত্র (laws of physics) অস্তিত্ব লাভ করেছে—সে সব সূত্র বিগত পনের শত কোটি বছরেও পরিবর্তিত হয়নি। তা ছাড়া, এ-সূত্রগুলো এতো সূক্ষ্ম হিসেব-নিকেশের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে, সামান্যতম এদিক-ওদিক হলেও, এ-বিশ্বজগতের গোটা কাঠামো ও প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।
বর্তমান বিশ্বের সবচে আলোচিত ও বিখ্যাত পদার্থবিদ প্রফেসর স্টিফেন হকিং (Prof. Stephen Hawking) তার বেস্ট সেলার গ্রন্থA Brief History of Time-এ বলেছেন যে, এ-বিশ্বজগত এমনসব সূক্ষ্ম হিসেব-নিকেশ ও ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

বিশ্বজগতের সম্প্রসারণের মাত্রা সম্পর্কে স্টিফেন হকিং বলছেন:
“(বিগ ব্যাং-এর পর) বিশ্বজগত সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছিলো ক্রিটিক্যাল মাত্রার (critical rate of expansion) খুবই কাছাকাছি গতিতে। ঠিক ওই মাত্রায় সম্প্রসারিত হওয়া শুরু করেছিলো বিধায়, বিশ্বজগত শুরুতেই ধ্বংস হয়ে যাবার পরিবর্তে সুশৃঙ্খলভাবে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। আজো—বিগ ব্যাং-এর দশ হাজার মিলিয়ন বছর পরেও—বিশ্বজগত সম্প্রসারিত হচ্ছে ক্রিটিক্যাল গতির কাছাকাছি গতিতেই। প্রশ্ন হচ্ছে: কেন? কেন এ-বিশ্বজগত ওই গতিতে সম্প্রসারিত হতে শুরু করেছিলো? যদি, বিগ ব্যাং-এর এক সেকেন্ড পরে সম্প্রসারণের মাত্রা কোটি কোটি কোটি ভাগের একভাগও কম হতো, তবে আমাদের এ-বিশ্বজগত বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই ধ্বংস হয়ে যেত!”-(দেখুন: Stephen W Hawking, A Brief History of Time, Bantam Books, April, 1988, p.121)

বর্তমান বিশ্বজগতের কাঠামো এবং এতে বিদ্যমান সূক্ষ্ম ভারসাম্য সম্পর্কে পল ডেভিসের বক্তব্যও এখানে প্রণিধানযোগ্য। ডেভিস বলছেন:
“এমন ধারণা মনে স্থান দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা খুবই কঠিন যে, বিশ্বজগতের বিদ্যমান কাঠামো—যা কিনা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনের ব্যাপারেও স্পর্শকাতর—যত্নের সঙ্গে চিন্তা-ভাবনা করেই অস্তিত্বে আনা হয়েছে …।”-(দেখুন: Paul Davies, God and the New Physics, New York: Simon & Schuster, 1983, p.189)

একই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দেখা যায় জর্জ গ্রিনস্টেইনকেও (George Greenstein)। আমেরিকার এই জ্যোতির্বিদ প্রফেসর তার The Symbiotic Universe নামক গ্রন্থে বলছেন:
“(বিশ্বজগতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা) বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করবার পর, তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের মনে যে-চিন্তার উদয় হয় তা হচ্ছে: (বিশ্বজগত সৃষ্টির পেছনে) নিশ্চয়ই কিছু অতিপ্রাকৃতিক এজেন্সির (some supernatural agencies)—বা মাত্র একটি এজেন্সির—হাত আছে।”-(দেখুন: Hugh Ross, The Fingerprint of God, 2nd ed., Orange, CA: Promise Publishing Co., 1991, p.114-115)

বস্তুর সৃষ্টি (The Creation of Matter)

অগুনতি পরমাণু (atom) একত্রিত হয়ে বস্তু (matter) গঠন করে। আর এ-পরমাণু অস্তিত্ব লাভ করেছে বিগ ব্যাং-এর পর। অসংখ্য পরমাণু একত্রিত হয়েই পৃথিবী, সূর্য, ও তারকারাজিসহ এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টি করেছে। পরবর্তী কালে এ-পরমাণুই একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এ-পৃথিবীর বুকের সকল প্রাণ। আপনার চারপাশে আপনি যা-কিছু দেখছেন—আপনার শরীর, যে-চেয়ারে আপনি বসে আছেন সেটি, এ-মুহূর্তে যে-বইটি আপনি হাতে নিয়ে পড়ছেন সেটি, আকাশ (যা জানলা দিয়ে আপনি এ-মুহূর্তে দেখছেন), মাটি, কংক্রিট, ফলমূল, বৃক্ষরাজি, সকল দৃশ্যমান ও অদৃশ্য প্রাণী—সবকিছুই অস্তিত্ব লাভ করেছে অসংখ্য পরমাণু একত্রিত হবার ফলে।

প্রশ্ন হচ্ছে: পরমাণু কী? যে-পরমাণু সকল বস্তু সৃষ্টির জন্য দায়ী—সে পরমাণু কী দিয়ে তৈরী এবং এর কাঠামোটাইবা কেমন?

যখন আমরা পরমাণুসমূহের কাঠামো (structure) পর্যবেক্ষণ করি, তখন দেখতে পাই যে, প্রত্যেকটি পরমাণু একটি চমৎকার ডিজাইন অনুসারে গঠিত এবং এদের প্রতিটি কাঠামোতে সূক্ষ্ম শৃঙ্খলা বিদ্যমান। প্রতিটি পরমাণুর একটি কেন্দ্রস্থল (nucleus) আছে এবং সে-কেন্দ্রস্থলে আছে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রোটন (proton) ও নিউট্রন (neutron)। শুধু তাই নয়, পরমাণুসমূহে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকট্রোনও (electrons) আছে। ওই ইলেকট্রোনগুলো কেন্দ্রস্থলের চতুর্দিকে অবিরাম ঘুরে চলেছে সেকেন্ডে এক হাজার কিলোমিটার বেগে (দেখুন: A Dorling Kindersley Book—The Science, published in the United States by Dorling Kindersley Inc., p.24)। যে-কোনো পরমাণুতে ইলেকট্রোন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান থাকে। ধনাত্মক প্রোটনসমূহ ও ঋণাত্মক ইলেকট্রোনসমূহ সবসময় একে অন্যকে ব্যালান্স করে। ইলেকট্রোন ও প্রোটনের সংখ্যায় কোনো হেরফের হলে, পরমাণুর অস্তিত্বই থাকতো না, কারণ তাতে করে পরমাণুর ইলেকট্রোমেগনেটিক ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যেতো। পরমাণুর কেন্দ্রস্থল বা নিউক্লিয়াস—প্রোটনসমূহ ও নিউট্রোনসমূহ নিয়ে যা গঠিত—ও এর চারপাশের ইলেকট্রোনসমূহ সর্বদাই গতিশীল। এগুলো নিজেদের চারপাশে এবং একে অপরের চারপাশে বৃত্তাকারে নির্ভুলভাবে ঘুরে চলেছে, নির্দিষ্ট গতিতে। প্রতিটি পরমাণুর মধ্যকার বিভিন্ন উপাদানের এই গতি, পরমাণুর অস্তিত্বের জন্য অত্যাবশ্যক। সৃষ্টির পর থেকে প্রতিটি পরমাণুতে এ-গতির অস্তিত্ব লক্ষণীয়; এতে আজ পর্যন্ত কোনো বিশৃঙ্খলা, পার্থক্য বা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
এটা খুবই চমৎকৃত হবার মতো বিষয় যে, পরমাণুর মতো একটি সর্বোচ্চ মাত্রার সুশৃঙ্খল ও সুনির্ধারিত সত্ত্বার (entity) আবির্ভাব ঘটেছিল শূন্যে একটি মহা-বিস্ফোরণের পর। অথচ বিগ ব্যাং যদি একটি অনিয়ন্ত্রিত ও দৈবক্রমে-ঘটা বিস্ফোরণ হতো, তবে বিস্ফোরণের পর বিশৃঙ্খলভাবে পরবর্তী ঘটনাসমূহ ঘটতো এবং তাতে, আর যা-ই হোক, পরমাণুর মতো অসাধারণ এক সৃষ্টি অস্তিত্বলাভ করতো না।
সত্যি বলতে কি, বিশ্বজগত সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই, মহাবিশ্বের প্রতিটি পয়েন্টে সুশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিভিন্ন স্থানে ও কালে বিভিন্ন পরমাণুর সৃষ্টি হলেও, এগুলোর গঠন-প্রণালী দেখে যে-কারো মনে হতে পারে যে, সবধরনের পরমাণূ একই কারখানা থেকে উৎপাদন করা হয়েছে, তবে তা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে। প্রথমে পরমাণূসমূহ সৃষ্টি হয়েছে। তারপর অসংখ্য পরমাণু মিলিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে বস্তুর(matter) এবং বিভিন্ন বস্তু মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে অর্থপূর্ণ বিভিন্ন জিনিস (objects)। এ-প্রক্রিয়ায় কোনো অস্বাভাবিক, অপ্রয়োজনীয় বা অর্থহীন জিনিস সৃষ্টি হয়নি, না এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যার কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই। বিশ্বজগতে যা-কিছু সৃষ্টি হয়েছে—ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস থেকে শুরু করে বৃহদাকার সৃষ্টি পর্যন্ত—তার সবকিছুই সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল, ও উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে সৃষ্ট।

এসবকিছুই প্রমাণ করে যে, একজন মহান স্রষ্টা আছেন—যিনি সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্বজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তার ক্ষমতাবলে যখন যা ইচ্ছা সৃষ্টি করতে সক্ষম। তিনি মহা ক্ষমতাবান এক স্রষ্টা। আল-কুরআন বলছে:
“তিনিই যথাবিধি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন। যখন তিনি বলেন, ‘হও’—অমনি তা হইয়া যায়। তাহার কথাই সত্য।”–(সুরা আনআম, আয়াত-৭৩)।

বিগ ব্যাং-এর পর “একটা নির্দিষ্ট অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হয়েই আমি বলবো যে, এ-বিশ্বজগতের একটা উদ্দেশ্য (purpose) আছে। এ-বিশ্বজগত দৈবক্রমে বা এমনি এমনি অস্তিত্ব লাভ করেনি। অনেকে মনে করেন যে, এ-বিশ্বজগত বরাবরই ছিল ও এর কার্যক্রম বরাবরই চলছে এবং দুর্ঘটনাক্রমে আমরা এর মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করেছি। আমি মনে করি না যে, বিশ্বজগতকে এ-ধরনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার মধ্যে কোনো উপকারিতা আছে। আমি মনে করি যে, এ-বিশ্বজগত ও বিশ্বজগতের অস্তিত্বের রহস্য অনেক গভীর এবং এ-সম্পর্কে এ-মুহূর্তে আমরা খুব কমই জানি।” (দেখুন:Stephen Hawking, A Brief History of Time: A Reader’s Companion, edited by Gene Stone, 1993, p.142)

ওপরের উদ্ধৃতিটি রজার পেনরোজের (Roser Penrose)। পেনরোজের বক্তব্য আমাদের জন্য চিন্তার খোরাক জোগায়। তিনি যেমনটি বলবার চেষ্টা করেছেন, অনেকেই সম্পূর্ণ ভুলভাবে এ-বিশ্বজগত সম্পর্কে চিন্তা করতে অভ্যস্ত। তাঁরা মনে করেন যে, এ-বিশ্বজগত চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা নিয়ে বিরাজ করছে কোনো কারণ ছাড়াই। তাঁরা আরো মনে করেন যে, এ-বিশ্বজগতে তাদের বেঁচে থাকবার কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই।
যেমনটি আগেই বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে এ-বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়েছে। আর একটি মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে একটি পারফেক্ট ও সুশৃঙ্খল সৃষ্টিজগতের অস্তিত্বলাভের ঘটনাকে, আর যা-ই হোক, অনিয়ন্ত্রিত ও উদ্দেশ্যহীন বলা যেতে পারে না।

আসুন, আমরা এ-বিশ্বজগতের অপূর্ব ব্যবস্থাপনার দিকে আরো একবার লক্ষ্য করি।  আমরা দেখবো যে, এ-বিশ্বজগত সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্যপূর্ণ ও এর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল অথচ সম্পূর্ণ ত্র“টিমুক্ত। আর এ-জন্যেই এ-বিশ্বজগতকে এবং এর ত্রুটিহীন ব্যবস্থাপনাকে কাল্পনিক দৈব কারণসমূহ (coincidental causes)দিয়ে ব্যখ্যা করা যায় না। এটা তো ষ্পষ্ট যে, ভারসাম্যপূর্ণ এই চমৎকার বিশ্ব নিজেকে নিজে সৃষ্টি করেনি, না এটি বিগ ব্যং বা মহা-বিস্ফোরণের পর কাকতালীয়ভাবে বা দৈবক্রমে অস্তিত্বলাভ করেছে। একটা মহা-বিস্ফোরণের পর অমন ভারসাম্যপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল বিশ্বজগত সৃষ্টি হতে পারে কেবল অতিপ্রাকৃতিক কোনো শক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলেই।
আমাদের এ-বিশ্বজগতের প্রতি একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালেই বোঝা যায় যে,  বিশ্বজগতকে সৃষ্টি করা হয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অধীনে। আর পরিকল্পনা যখন আছে, তখন পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্বও তো থাকবে! এই পরিকল্পনাকারীই হচ্ছেন স্রষ্টা। এ-বিশ্বজগতের পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, এর একজন স্রষ্টা আছেন—যিনি অসীম জ্ঞান, শক্তি, ও প্রজ্ঞার অধিকারী। এই অসীম ক্ষমতাবান স্রষ্টাই বস্তু সৃষ্টি করেছেন শূন্য থেকে এবং এর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার কাজ করে যাচ্ছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। এই মহান স্রষ্টাই হচ্ছেন আল্লাহ। আল্লাহ পৃথিবী ও আসমানসমূহের এবং উভয়ের মাঝখানে যা-কিছু আছে—সবকিছুর মালিক।

বিশ্বজগতে বিদ্যমান পরিকল্পনার সুস্পষ্ট ছাপ, ডিজাইন, ও শৃঙ্খলার অস্তিত্ব আবিস্কার করবার মাধ্যমে, আধুনিক বিজ্ঞান কার্যত একজন স্রষ্টার অস্তিত্বই আবিস্কার করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা আবিস্কৃত অসংখ্য তথ্য-প্রমাণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বজগত সম্পর্কে ঊনবিংশ শতাব্দীর বস্তবাদী দর্শন একেবারেই অগ্রহণযোগ্য একটি ‘ডগমা’ বৈ আর কিছু নয়।
বস্তবাদী দর্শন এতদিন বিজ্ঞানের দোহাই দিত, বা কখনো কখনো নিজেকেই ‘বিজ্ঞান’ বলে জাহির করতো। এ-দর্শন অনুসারে, যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এ-বিশ্বজগতে বস্ত ছাড়া আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই; বস্তু তথা এ-বিশ্বজগত অনাদিকাল থেকে অস্তিত্বশীল ছিল এবং অনন্তকাল পর্যন্ত অস্তিত্বশীল থাকবে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান বস্তুবাদী দর্শনের এ-দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। এমন একদিন আসবে—যেদিন যুক্তি ও বিজ্ঞানের মোকাবিলায়, বস্তুবাদকে স্রেফ একটি আদিম ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস হিসেবে মনে রাখা হবে।

আকাশ এবং পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা অসংখ্য নিদর্শনৎ

মনে করুন, লক্ষ লক্ষ লেগো (Lego) দিয়ে আপনি একটি বড় শহর তৈরী করেছেন। শহরটিতে আকাশছোঁয়া অনেক বিল্ডিং আছে; আছে আঁকাবাঁকা অসংখ্য রাস্তা, রেলওয়ে স্টেশন, বিমানবন্দর, ছোটোবড় শপিং মল, পাতাল রেল, নদ-নদী, লেক, বনভূমি, ও একটি চমৎকার সমুদ্র সৈকত। ধরুন, লক্ষ লক্ষ লোক এ-শহরের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে; আবার অনেকে নিজ নিজ ঘরে বসে আরাম করছে বা অফিসে-আদালতে কাজ করছে। ছোটোখাটো বিষয়গুলোর কথাও মনে করুন। ট্রাফিক লাইট, রাস্তার ওপরে বা মোড়ে মোড়ে স্থাপিত বিভিন্ন আকারের ও রং-এর বিলবোর্ডগুলোর কথাও ভুলে যাবেন না।

এখন ধরুন, একজন আপনার কাছে এলো এবং এসে বললো যে, গোটা শহরটি একটি দুর্ঘটনার ফল। আপনি গোটা শহরটি তৈরী করেছেন আগাগোড়া একটি পরিকল্পনা অনুসারে; ছোটোখাটো বিষয়গুলিও আপনার মনোযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়নি। আপনি এক-একটি লেগো অতি যত্নের সঙ্গে উঠিয়েছেন এবং জায়গামতো বসিয়েছেন এবং বসিয়েছেন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। এরই পরিণতিতে গড়ে উঠেছে এই শহর। আর আলোচ্য ভদ্রলোক বলছেন যে, গোটা শহরটিই গড়ে উঠেছে স্রেফ একটি দুর্ঘটনার ফলে! এখন বলুন, লোকটি সম্পর্কে আপনার মনে কী ধারণা হবে?
এখন চলুন আমরা আপনার বানানো শহরে আবার ফিরে যাই। ধরা যাক, আপনি এমনভাবে শহরটি তৈরী করেছেন যে, মাত্র একটি লেগো স্থানচ্যুত হলে বা নিজের স্থান ছাড়া অন্য স্থানে বসানো হলে, গোটা শহরটাই মাটির সঙ্গে মিশে যাবে বা অন্যভাবে বললে, ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাবুন তো, কী অসাধারণ ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে আপনাকে শহর তৈরীর সময়!

এবার আপনার বানানো কাল্পনিক শহর থেকে চলুন বাস্তবের বিশ্বে। এ-বিশ্বে প্রাণের উৎপত্তি সম্ভব হয়েছে তেমনি অসংখ্য সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অথচ অতি-প্রয়োজনীয় বিষয়ের সমন্বয়ে। গোটা চিত্রটা মানুষের কল্পনারও বাইরে! ক্ষুদ্রতম একটি উপাদানের অনুপস্থিতিতেও সম্ভর ছিল না এ-বিশ্বে প্রাণের উৎপত্তি বা টিকে থাকা!
এ-মহাবিশ্বে সবকিছু কাজ করছে এক অনন্যসাধারণ ও পারফেক্ট প্রক্রিয়ায়। বস্তুর ক্ষুদ্রতম অংশ পরমাণু থেকে শুরু করে, কোটি কোটি কোটি তারকাসমৃদ্ধ গ্যালাক্সিসমূহ; পৃথিবীর অবিচ্ছেদ্য সাথী চাঁদ থেকে শুরু করে, আমাদের গোটা সৌরজগত—সবকিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কাজ করে চলেছে সুশৃংখলভাবে। সবকিছুই চলছে একটি সিস্টেমের অধীন এবং এ-সিস্টেমটিকে তুলনা করা চলে একটি ঘড়ির সঙ্গে। এ-সিস্টেমটি কোটি কোটি বছর ধরে এতো নিখুঁতভাবে কাজ করছে যে, মানুষ এর ওপর ভরসা করে দিব্যি নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করে যাচ্ছে। শুধু কি তাই? মানুষ আগামী দশ বছরের বা পঞ্চাশ বছরের পরিকল্পনা করতেও দ্বিধা করছে না। কারণ, কোটি কোটি বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত এ-সিস্টেমটি আগামীতেও অমন নিখুঁতভাবেই এবং কোনো রকম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ব্যতিরেকেই অটুট থাকবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করে। আগামীকাল সূর্য উঠবে কি উঠবে না—এ নিয়ে কারো মনেই বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই; নেই কোনো উদ্বেগ। “সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে, আমাদের এই পৃথিবীটার মহাশূন্যের অচেনা-অজানা অন্ধকারে চলে যাবার সম্ভাবনা আছে কি?”—এ ধরনের প্রশ্ন বলতে গেলে কোনো মানুষের মনেই জাগে না; না কেউ প্রশ্ন করে: “কে তা ঘটতে দিচ্ছে না?”।
মানুষ যখন ঘুমায়, তার ব্রেন বিশ্রাম নেয়। কিন্তু মানুষের ঘুমের সময়ও তার হার্ট চলতে থাকে অবিরাম; অবিরাম চলতে থাকে শ্বাসযন্ত্রও। ঘুমের সময় তার হার্ট চলবে, চলবে শ্বাসযন্ত্রও—এ নিয়ে কি কখনো সে সন্দিহান হয়ে ওঠে? না, ওঠে না। সে কতো নিশ্চিতই না থাকে এ-ব্যাপারে! অথচ হার্টের ক্রিয়া বা শ্বাসযন্ত্রের কাজ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে গেলেও হতে পারে তার মৃত্যু!!
আমরা জানি যে, এ সবই প্রাকৃতিক নিয়মে চলছে। কিন্তু এ-নিয়মই বা কে সৃষ্টি করেছেন? কে এমন একটি সূক্ষ্ম, জটিল, ও বিশাল সিস্টেম চালু করে দিয়েছেন—যা এক চুল পরিমাণ এদিক-ওদিক হলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে? বস্তুত, একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের জীবন যেন লটকে আছে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম সুতার ওপর। এ কার পরিকল্পনার ফল? এ সৃষ্টিজগতের যেখানেই আপনি দৃষ্টি ফেলবেন, দেখবেন কী চমৎকার ও পারফেক্ট শৃংখলা এবং ভারসাম্য বজায় আছে সর্বত্র; কোথাও কোনো খুঁত নেই। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এ অসাধারণ শৃংখলা ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার স্রষ্টা একজন মহা-ক্ষমতাবান সত্ত্বা। এই মহা-ক্ষমতাবান সত্ত্বাই হচ্ছেন আল্লাহ—যিনি সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন শূন্য থেকে। কুরআন এ-সম্পর্কে কী বলছেন শুনুন:
“যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোনো খুঁত দেখিতে পাইবে না; তুমি আবার তাকাইয়া দেখ, কোনো ক্রটি দেখিতে পাও কি? অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও; সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হইয়া তোমার দিকে ফিরিয়া আসিবে।”–(সুরা মুল্ক; আয়াত-২ ও ৩)।

যখন আমরা আসমান, পৃথিবী এবং আসমান ও পৃথিবীর মাঝখানে যা-কিছু আছে—সেসবের দিকে তাকাই, তখন উপলদ্ধি করি যে, এ সবকিছুই একজন স্রষ্টার অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। এই অধ্যায়ে আমরা কিছু প্রাকৃতিক ফেনোমেনন  বা প্রপঞ্চ ও জীবন্ত বস্তুর অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করবো। এ সবকিছুই আমাদের চোখের সামনেই আছে। প্রতিনিয়ত আমরা সেগুলো দেখছি। কিন্তু কখনো এগুলো নিয়ে আমরা সাধারণত চিন্তা করি না। কীভাবে এদের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে? কীভাবে এরা টিকে আছে? সাধারণভাবে এ-ধরনের প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে না। অথচ এগুলোই হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ; এগুলো হচ্ছে আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শনের অন্তর্গত। বিশ্বজগতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এ-ধরনের নিদর্শনের ব্যাপারে লিখতে হলে হাজার হাজার খন্ড বিশ্বকোষ লিখতে হবে। এখানে আমরা তাই মাত্র কয়েকটি নিদর্শন নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো। যারা বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ও বোধসম্পন্ন এবং যারা উন্মুক্ত মন ও মগজ নিয়ে চিন্তা করতে জানেন—তাঁদের জন্য এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাই যথেষ্ট হবে বলে আশা করি।

আমাদের শরীর ও মিরাকল বা মোজেজা (miracles)

১.    ‘একটি অপূর্ণাঙ্গ চোখ দেখতে পারে না’

‘চোখ’ শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনে সর্বপ্রথম কোন ভাবনার উদয় হয়? দেখবার ক্ষমতা যে আপনার জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—সে সম্পর্কে আপনি কি সচেতন আছেন? ধরে নিচ্ছি, আপনি এ-ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার চোখ স্রষ্টার কোন কোন নিদর্শন (sign) বহন করছে?
মানুষসহ অন্যান্য জীবিত প্রাণী যে সৃষ্ট, তার সবচে স্পষ্ট প্রমাণগুলোর একটি হচ্ছে এই ‘চোখ’। চোখ মানেই পারফেক্ট ডিজাইন। মানুষসহ সকল জীব-জানোয়ার যে-অঙ্গটি দিয়ে তার চারপাশের সবকিছু দেখে বা দেখতে পারে—সে-অঙ্গটিকে ‘পারফেক্ট ডিজাইন’-এর উদাহরণও বলা যেতে পারে। এই অসাধারণ অঙ্গটি এমন জটিল যে, মনুষ্য-সৃষ্ট সবচে সফিসটিকেটেড ও জটিল যন্ত্রও এর কাছে নস্যি!
একটা চোখ দিয়ে কখন দেখা যায়? উত্তর: যখন চোখের সবগুলো অংশ সহাবস্থান করে এবং একসঙ্গে কাজ করে। ধরা যাক, চোখের পাতা (eyelid) ছাড়া, একটি চোখের কর্ণিয়া আছে;  আছে চোখের তারা, লেন্স, কনীনিকা (iris), রেটিনা, চক্ষুপেশী, অশ্রুগ্রন্থি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সকল উপাঙ্গ। কী ঘটবে? খুব দ্রুত চোখ তার দেখার ক্ষমতা হারাবে। আবার ধরা যাক, চোখের পাতাসহ চোখের অন্যসব উপাঙ্গই বর্তমান আছে, শুধু চোখে অশ্রু উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। কী ঘটবে? খুব দ্রুত চোখ শুকিয়ে যাবে এবং একসময় তা অন্ধ হয়ে যাবে।

বিবর্তনবাদীদের বিশ্বাস এই চোখের কাছে এসে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য। তাঁরা বিশ্বাস করে যে, জীব-জন্তুদের (মানুষসহ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরল অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে জটিলতর হয়েছে দৈবক্রমে। যদি তা-ই হয়, তবে চোখ-কে ব্যাখ্যা করা যায় কী প্রকারে? চোখ হচ্ছে অনেকগুলো উপাঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত জটিল একটি অঙ্গ এবং, যেমনটি ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে, সকল উপাঙ্গ একসঙ্গে কাজ করলেই কেবল এটি দেখবার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কোনো অবস্থাতেই একটি অপূর্ণাঙ্গ চোখ কাজ করে না; না একটি অর্ধ-উন্নত (half-developed) চোখ পূর্ণাঙ্গ চোখের তুলনায় অর্ধেক দেখতে পারে!

এ-প্রসঙ্গে একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীর বক্তব্য শুনুন:
“(জীব-জন্তুর) চোখ এবং (পাখীদের) পাখার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই এমন যে, এগুলো পূর্ণাঙ্গ এবং পূর্ণভাবে বিকশিত অবস্থাতেই কেবল কাজ করতে পারে। অন্যভাবে বললে, একটি অর্ধ-বিকশিত (halfway-developedচোখ দেখতে পারে না; না একটি অর্ধ-বিকশিত-পাখাওয়ালা পাখী উড়তে পারে।”–[সূত্র: Bilim ve Teknik magazine (Science and Technology Magazine), vol. 203, p.23]

এখন, আমরা আবারো সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হই: কে চোখের সকল অংশ বা প্রত্যঙ্গগুলো একসঙ্গে সৃষ্টি করেছেন?
এটাতো স্পষ্ট যে, মানুষসহ কোনো জন্তু-জানোয়ারই নিজেদের চোখের গঠন ও ধরণ কেমন হবে—তা ঠিক করেনি; না তারা নিজেরাই নিজেদের চোখ সৃষ্টি করে নিজেদের দেহে সংযুক্ত করে নিয়েছে। তাহলে? কে তিনি—যিনি চোখের মতো জটিল ও অসাধারণ একটি অঙ্গের ডিজাইন করেছেন এবং  একে অস্তিত্বে এনেছেন? কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করেন যে, অচেতন কোষ হঠাৎ করেই এবং দৈবক্রমে সচেতনতা লাভ করবার ফলেই প্রানীরা দেখবার ও শুনবার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এ-দাবী যে কতো অযৌক্তিক ও অবাস্তব—তা ব্যাখ্যা করে বোঝাবার দরকার পরে না। প্রশ্ন হচ্ছে: তাহলে কীভাবে চোখ বা কানের মতো বিশেষ অঙ্গের সৃষ্টি সম্ভব হলো? এখানে এসেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় একজন মহাজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান স্রষ্টার অস্তিত্বকে। একজন মহান স্রষ্টাই মানুষসহ অন্যান্য জীব-জন্তুকে দিয়েছেন দেখবার ক্ষমতা।
আল-কুরআন বলছে যে, একজন মহান স্রষ্টাই সৃষ্টি করেছেন দৃষ্টিশক্তি:
“বল, ‘তিনিই তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তোমাদিগকে দিয়াছেন শ্রবনশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’”–(আল-কুরআন; সুরা-কালাম, আয়াত-২৩)

২. কোষগুলো পরস্পরকে চেনে কীভাবে?
আমাদের মধ্যে অনেকেই মানব-শরীরের গঠন সম্পর্কে জানি। আমরা জানি কীভাবে মায়ের জরায়ুর মধ্যে ধীরে ধীরে একটি মানবশিশুর শরীর বিকশিত হয়। শুক্রানু ও ডিম্বানুর মিলনের পর, মায়ের পেটে যে-ভ্রুণের সৃষ্টি হয়—তা মূলত একখন্ড মাংসপিন্ড বৈ আর কিছু নয়। এ-ভ্রুণই ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুতে রূপান্তরিত হয়। আমরা জানি, শুক্রাণু ও ডিম্বানুর মিলনের ফলে জাইগোটের সৃষ্টি। সে-জাইগোটে প্রথমে থাকে মাত্র দুটি কোষ বা cell। তারপর, দুটি থেকে চারটি, চারটি থেকে আটটি, আটটি থেকে ষোলটি—এভাবে কোষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। ক্রমবর্ধমান ওই কোষগুলোই পরবর্তী কালে সৃষ্টি করে পূর্ণাঙ্গ মানবদেহের। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, গোটা প্রক্রিয়াটি চলবার সময়, কোষগুলো বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় এবং কিছু কোষ মিলিত হয়ে হাত সৃষ্টি করে, কিছু কোষ সৃষ্টি করে শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কিছু কোষ মিলিত হয়ে সৃষ্টি করে চোখ ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি কোষ জানে যে, কোথায় তাকে যেতে হবে এবং কোন কোষগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে কোন অঙ্গ সৃষ্টি করতে হবে! মায়ের পেটে ভ্রুণের বিকশিত হবার অত্যাশ্চর্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে নিচের উদ্ধৃতিটি থেকে:
“গবেষণাগারের উপযুক্ত পরিবেশে যদি আমরা ভ্রুণের সকল কোষকে—যে-কোষগুলো বিভিন্ন অঙ্গ সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত—আলাদা করে ফেলি এবং পরে আবারো উপযুক্ত পরিবেশে সেগুলোকে এলোমেলোভাবে মিলিয়ে দিই, তবে দেখা যাবে যে, কোষগুলো ঠিকই পরস্পরকে চিনতে পারছে এবং বিভিন্ন অঙ্গের জন্য নির্ধারিত কোষগুলো ঠিকই মিলিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ তৈরী করছে!”–(সূত্র: Prof. Dr. Ahmet Noyan, Physiology in Life and in the Field of Medicine, Meteksan Publishing, Ankara, 1998, Edition 10, p.40)

অর্থাৎ কোন কোন কোষ মিলে কোন কোন অঙ্গ গঠিত হবে—তা পূর্বনির্ধারিত। শুধু তাই নয়, কোষগুলো নিজেদের কাজ সম্পর্কেও সম্যক ওয়াকেফহাল! হাত সৃষ্টির জন্য নির্ধারিত কোষগুলোর একটিও কখনো চোখ সৃষ্টির জন্য নির্ধাারিত কোষগুলোর সঙ্গে মিলিত হবে না!! কারণ, একটি নির্দিষ্ট অঙ্গের জন্য নির্ধারিত কোষগুলো পরস্পরকে ভালোভাবেই চেনে!!!
ভ্রুণের এই কোষগুলোর কোনো ব্রেন নেই; নেই কোনো নার্ভাস-সিস্টেম, চোখ বা কান। তাহলে, এরা কী প্রকারে একে অপরকে চিনতে পারে? কিছু অণুর সমন্বয়ে গঠিত এবং চেতনা ও জ্ঞান-বুদ্ধিবিহীন এই কোষ কী প্রকারে সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অন্য কোষকে ভিন্নবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বহু কোষের মধ্য থেকে আলাদা করতে পারে? কীভাবে এরা জানে যে, এরা মানবশিশুর জন্মের প্রক্রিয়ার এক পর্যাযে পরস্পর মিলিত হয়ে একই অঙ্গ গঠন করবে? অচেতন অণুর অমন সচেতন আচরণ-এর পেছনে কোন শক্তি কাজ করছে? বলা বাহুল্য, এ-শক্তি হচ্ছেন আল্লাহ—যিনি জগতসমূহের রব এবং যিনি জগতসমূহ সৃষ্টি করেছেন শূন্য থেকে।
কুরআন বলছে:
“আমি তাহাদের জন্য আমার নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করিব—বিশ্বজগতে এবং তাহাদের নিজেদের মধ্যে; ফলে তাহাদের নিকট সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে যে, ইহাই সত্য। ইহা কি তোমাদের প্রতিপালকের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তিনি সর্ববিষয়ে অবহিত?”–(আল-কুরআন; সুরা: হা-মীম আস্-সাজদা, আয়াত-৫৩)

৩. মানুষের শরীরের অভ্যন্তরের সৈন্যবাহিনী

প্রতিদিন, আপনার অজান্তেই, আপনার শরীরের অভ্যন্তরে যুদ্ধ চলছে! এ-যুদ্ধে একপক্ষে আছে অসংখ্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া। এরা আপনার শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, আপনার শরীরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে আগ্রহী। যুদ্ধের অপরপক্ষ হচ্ছে আপনার শরীরের অসংখ্য রোগপ্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন কোষ—যেগুলো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মতো ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে হামেশা লড়াই করে আপনার শরীরকে রোগমুক্ত রাখবার চেষ্টায় রত।
ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মতো শক্ররা সবসময়ই আক্রমণাত্মক। সুযোগ পেলেই এরা শরীরের নির্দিষ্ট অংশে আঘাত হানতে এগিয়ে যায় সর্বশক্তি নিয়ে। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট এলাকার শক্তিশালী, সুশৃংখল ও সুসংগঠিত রোগপ্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন কোষগুলো—যেগুলোকে সৈন্যও বলা যায়—ওই শক্রদের সহজে অনুপ্রবেশ করতে দেয় না। এই সৈন্য-কোষগুলোর মধ্যেও আছে নানান ভাগ। প্রথমে ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ অবতীর্ণ হয় সেসব ‘সৈন্য’—যেসব সৈন্য শত্র“পক্ষের সৈন্যদের রীতিমতো গিলে খেয়ে ফেলে এবং তাদেরকে অকার্যকর করে দেয়। তবে, এই ‘গিলে খেতে সক্ষম’ সৈন্যরা যুদ্ধে পরাজিত হলে, অন্যান্য সৈন্যদের ডেকে পাঠানো হয়। তেমন ক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে অর্থাৎ শরীরের নির্দিষ্ট অংশে বিপদ সংকেত বেজে ওঠে এবং অন্যান্য সৈন্যকেও (সাহায্যকারী ‘টি’ সেল – helper T cells) যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন-আসা সৈন্যরা অতিসহজেই শত্রপক্ষ থেকে মিত্রপক্ষকে আলাদা করতে পারে। অতিদ্রুত এরা ‘যুদ্ধাস্ত্র’  উৎপাদনে সক্ষম সৈন্যদের (‘বি’ সেল) সক্রিয় করে তোলে। এই ‘বি’ সেলগুলোর ক্ষমতা অসাধারণ। যদিও এরা শক্রপক্ষের সৈন্যদের কোনোদিন দেখেনি বা চেনেনা, তথাপি এরা শক্রপক্ষের সৈন্যদের অকার্যকর করে দিতে সক্ষম অস্ত্র তৈরী করতে পারে। পাশাপাশি, এরা উৎপাদিত অস্ত্র যতোটুকু দূরে প্রয়োজন—ততোটুকু দূর পর্যন্ত বহন করেও নিয়ে যায়। অস্ত্র বহন করে নিয়ে যাবার পথে এরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের এবং মিত্রপক্ষের সৈন্যদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়—সেদিকে লক্ষ্য রাখতে পারে (অথচ এ-কাজটি মোটেই সহজ নয়!)। এদিকে, সবার শেষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় আক্রমণকারী সৈন্য (কিলার ‘টি’ সেল)। এরা শক্রপক্ষের সৈন্যদের দুর্বলতম স্থানে, নিজেদের সঙ্গে বহন-করে-আনা বিষময় বস্তু  নিক্ষেপ করে। যুদ্ধে বিজয়ী হলে, সৈন্যদের একটি নতুন গ্রুপ (suppressor T cells) যুদ্ধক্ষেত্রে আসে এবং অন্যান্য সকল সৈন্যকে নিজ নিজ ক্যাম্পে ফেরত পাঠায়। সবশেষে যুদ্ধক্ষেত্রে আসে যে-গ্রুপটি (memory cells)—সে গ্রুপটির কাজ হচ্ছে শত্রুপক্ষ সম্পর্কে সকল ধরণের তথ্য রেকর্ড করা। বলা বাহুল্য, রেকর্ড-করা এসব তথ্য কাজে লাগে ভবিষ্যতে আবারো আক্রান্ত হলে।
ওপরে আমরা যে অসাধারণ ও সুশৃংখল সৈন্যবাহিনীর বর্ণনা দিলাম, এটি হচ্ছে আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বাimmune system। ওপরে যুদ্ধের যে-বর্ণনা দেয়া হলো, সে-যুদ্ধে প্রতিনিয়ত যারা লিপ্ত—সে কোষগুলো খালি চোখে দেখা যায় না, সেগুলোকে দেখতে হয় অণূবিক্ষণযন্ত্র দিয়ে। (এ-সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন হারুন ইয়াহিয়ার গ্রন্থ The Miracle of the Immune System)
কয়জন লোক এ-ব্যাপারে সচেতন যে, তাদের প্রত্যেকের শরীরের অভ্যন্তরে আছে অমন একটি করে সুসংগঠিত, সুশৃংখল ও পারফেক্ট সৈন্যবাহিনী? এদের কতোজন এ-ব্যাপারে সচেতন আছেন যে, তাঁরা অসংখ্য রোগ-জীবাণু দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা না-থাকলে এরা প্রতিনিয়ত অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হতেন এবং মৃত্যুর মুখেও পতিত হতে পারতেন? বস্তুত, আমরা যে-বাতাসে শ্বাস নেই, যে-পানি পান করি, যে-খাদ্য গ্রহণ করি, যে-সব স্থান স্পর্শ করি—সর্বত্রই আছে ক্ষতিকর ও ভয়ংকর সব রোগ-জীবাণু দ্বারা পরিপূর্ণ। যখন একজন মানুষ এ-ব্যাপারে একেবারে উদাসীন, তখন শরীরের রোগপ্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন কোষসমূহ কিন্তু প্রতিনিয়ত রোগজীবাণুর বিরদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে সেই ব্যক্তিকে বাঁচানোর জন্য!
দেহকোষ থেকে রোগ-জীবাণূকে আলাদা করে চিনবার রোগপ্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন কোষগুলোর ক্ষমতা, শক্রকে না-দেখেও শক্রকে ধ্বংস করবার উপযোগী অস্ত্র তৈরী করবার ‘বি’ সেলের ক্ষমতা, নিজেদের এবং মিত্রপক্ষের কারো ক্ষতি না-করে প্রয়োজন মোতাবেক সে-সব অস্ত্র বহন করে নিয়ে যাবার ‘বি’ সেলের ক্ষমতা, মেমোরি সেলের ক্ষমতা ইত্যাদি হচ্ছে মানবদেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য।
বস্তুত, এ-কারণেই বিবর্তনবাদী লেখকরা কখনোই রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার উদ্ভব সম্পর্কে কোনো কথা বলতে নারাজ। বিবর্তনবাদ দিয়ে এ-সিস্টেমের উদ্ভব ব্যাখ্যা করা যায় না। এ-ধরণের একটি সিস্টেম কেবল একজন মহাজ্ঞানী ও সর্বশক্তিমান স্রষ্টার পক্ষেই সৃষ্টি করা সম্ভব।
রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়া বা ক্রটিযুক্ত রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে একজন মানুষের পক্ষে এই পৃথিবীতে টিকে থাকা প্রায়-অসম্ভব একটি কাজ। কারণ, সেক্ষেত্রে সে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হবে চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য রোগ-জীবাণু দ্বারা। আধুনিক যুগে চিকিৎসা-বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। তথাপি, আজও তেমন একজন ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাই বিশেষ ধরণের ব্যবস্থা —যে ব্যবস্থায় ব্যক্তিকে রাখতে হবে অন্যান্য সকল মানুষের বা অন্য যে-কোনো কিছুর সংস্পর্শ থেকে দূরে (এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কথাও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এইডস হলে একজন মানুষের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় বলেই, সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে।–অনুবাদক)। এখন মানবজাতির প্রাথমিক অবস্থার কথা ভাবুন। তখন তো কোনো চিকিৎসা-ব্যবস্থাই ছিল না! এ-অবস্থায় কি তখন দেহের ভেতরে পূর্ণাঙ্গ রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল? অবশ্যই না। তা হলে আমাদেরকে এ-সিদ্ধান্তে আসতেই হচ্ছে যে, মানবদেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার মতো একটি জটিল ও অতি-প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা একজন মহান স্রষ্টা কর্তৃক একবারেই সৃষ্ট হয়েছিল এবং শুরু থেকেই ওই সিস্টেমের সকল উপাদান উপস্থিত ছিল মানবদেহে।

পশু-পাখি ও উদ্ভিদজগৎ : স্রষ্টার নিদর্শন
পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা কোটি কোটি বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি ও উদ্ভিদ প্রমাণ করে যে, এ-সব কিছুর একজন মহান ও ক্ষমতাবান স্রষ্টা আছেন।
ওই জীবজগতের প্রতিটি সদস্যকে আলাদা আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করবার প্রযোজন আছে। তবে, এখানে মাত্র কয়েকটির ওপর আলোচনা সীমিত রাখা হবে–উদাহরণ হিসেবে। এদের প্রত্যেকের শারীরিক গঠন অনন্য। এরা প্রকৃতির নানান প্রতিকূলতার মধ্যে টিকে থাকবার বিচিত্র কায়দা-কানুন জানে। একেকটির কৌশল অন্যদের চেয়ে কমবেশি আলাদা। এদের খাদ্যগ্রহণ-পদ্ধতি ও প্রজনন-পদ্ধতিতেও লক্ষ্য করা যায় আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য! সমস্যা হচ্ছে, এদের সকলের বৈচিত্র্যময় শারীরিক গঠনশৈলী ও বৈচিত্র্যময় জীবনের ওপর আলোকপাত করা একটি গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, এর জন্য কয়েক খণ্ড বিশ্বকোষের সমপরিমাণ স্থানও যথেষ্ট প্রমাণিত হবে না!!
যেমনটি আগেই বলেছি, আমরা এখানে মাত্র কয়েকটি জীবের ওপর আলোচনা করবো। তাতেই প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি দৈবক্রবে বা দুর্ঘটনাক্রমে হয়নি এবং হতে পারে না; পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব ঘটেছে একজন মহান স্রষ্টার ইচ্ছার  ফল হিসেবে।

শুঁয়াপোকা থেকে প্রজাপতি
ধরা যাক, আপনার ৪০০-৫০০টি ডিম আছে এবং এগুলো আপনাকে সংরক্ষণ করতে হবে ঘরের বাইরে। আপনি কী করবেন? আপনি নিশ্চয়ই এমনভাবে ডিমগুলোকে সংরক্ষণ করবেন যাতে করে বাতাস বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক কারণে সেগুলো চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে না-যায়। গুঁটিপোকা (silkworm) একসঙ্গে ৪৫০ থেকে ৫০০ ডিম পাড়ে এবং সেগুলোকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সংরক্ষণ করে। গুঁটিপোকা তার নিজের শরীর থেকে সূতার মতো একধরণের আঠালো পদার্থ নিঃসরণ করে এবং সে-পদাথর্  দিয়ে ডিমগুলোকে একসঙ্গে বেধে রাখে!
এখন আসুন চোখ রাখি প্রজাপতির সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার দিকে। এক্ষেত্রে ডিম ফুটে প্রথমে বের হয় শুঁয়াপোকা (caterpillar)। এরা প্রথমে গাছের যে-কোনো একটি নিরাপদ ডাল বেছে নেয়। এরপর গাছের ডালের সঙ্গে নিজেদের বেধে রাখে ওই একই রকমের সূতার মতো আঠালো পদার্থ ব্যবহার করে! এই শুঁয়াপোকাই পরিবর্তিত হয়ে পরে পূর্র্ণাঙ্গ প্রজাপতি হয়। তবে, এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার সময়, শুঁয়াপোকাগুলো নিজেদের শরীর থেকে নিঃসৃত সূতার মতো আঠালো পদার্থ দিয়ে, নিজেদের শরীরের চারিপাশেকোকুন (cocoon) সৃষ্টি করে। কোকুন সৃষ্টির গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ করতে এরা সময় নেয় তিন থেকে চারদিন। এ-সময়ে প্রতিটি শুঁয়াপোকা হাজার হাজার ডিগবাজী খায় (কোকুন সৃষ্টির খাতিরে) এবং গড়ে নয়শত থেকে দেড় হাজার মিটার লম্বা আঠালো সূতা উৎপাদন করে–(সূত্র: Larousse Dictionary and Encyclopedia, vol.П, p.5734)। এই কোকুনের ভেতরে থেকেই শুঁয়াপোকা রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে: মা গুঁটিপোকা তার নিজের ডিমগুলোকে সংরক্ষণ করবার কৌশল কোথা থেকে শিখলো? ছোট্ট শুঁয়াপোকাই বা কীভাবে জানলো যে, তাকে গাছের ডালের সঙ্গে নিজেকে বেধে রাখতে হবে এবং নিজের শরীরের চারপাশে কোকুন সৃষ্টি করতে হবে? বলা বাহুল্য, মা গুঁটিপোকা বা ছোট্ট শুঁয়াপোকার আচরণ বিবর্তনবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। নিজের ডিমগুলোকে সংরক্ষণ করবার জন্য মা গুঁটিপোকার সূতার মতো আঠালো পদার্থ উৎপাদনের ক্ষমতা নিঃসন্দেহে অলৌকিক একটা বিষয়। সদ্য জন্ম-নেয়া শুঁয়াপোকা নিজেকে সুবিধাজনক একটি ডালের সঙ্গে বেধে নেয়া থেকে শুরু করে নিজের চারপাশে কোকুন সৃষ্টি করা এবং একটি অব্যর্থ রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুঁয়াপোকা থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হবার গোটা ব্যাপারটিও মানুষের ব্যাখ্যার অতীত। এক্ষেত্রে এটি ধরে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই যে, জন্মের আগেই প্রতিটি শুঁয়াপোকাকে এ-ব্যাপারে শিক্ষা দেয়া হয়েছে! প্রতিটি শুঁয়াপোকাই জানে যে, জন্মের পর তাকে কী কী করতে হবে এবং কোন কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে!!
গোটা ব্যাপারটা একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ধরা যাক, একটি মানবশিশু জন্মের মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং নিজে নিজেই লেপ, তোষক, বালিশ ইত্যাদি সংগ্রহ করবার পর বিছানা প্রস্তুত  করে তাতে শুয়ে পড়লো। গোটা দৃশ্যটা দেখে আপনি কী ভাববেন? প্রথমে নিঃসন্দেহে আপনি হতচকিত হবেন। তারপর ভাববেন যে, নিশ্চয়ই শিশুটিকে মায়ের গর্ভে থাকাকালীনই অলৌকিক উপায়ে সবকিছু শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই নয় কি? এই উদাহরণের মানবশিশুটির কমকান্ডের সঙ্গে আলোচ্য শুঁয়াপোকার কর্মকান্ডের আসলে কোনো পার্থক্য নেই!
এখানে এসে আমরা এই উপসংহারে উপনীত হতে বাধ্য যে, আলোচ্য জীবন্ত প্রাণিগুলোর জন্ম  ও জন্ম-প্রক্রিয়া এবং জন্ম নেয়ার পর এদের কর্মকান্ড ইত্যাদি সবই এদের স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত। কুরআন বলছে যে, স্রষ্টা নিজে মৌমাছিকে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং মধু উৎপাদন করবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন (কুরআন, ১৬: ৬৮-৬৯)। কুরআনের এই আয়াত প্রাণীজগতের এক মহান রহস্যকে উন্মোচন করেছে। রহস্যটা হচ্ছে: সকল সৃষ্ট জীবই স্রষ্টার ইচ্ছার অধীন এবং স্রষ্টার দ্বারা নির্ধারিত ভাগ্যই তারা বরণ করে নেয় বা নিতে বাধ্য হয়। এ-কারণেই মৌমাছি মধু উৎপাদন করে এবং গুঁটিপোকা উৎপাদন করে সিল্ক বা রেশম।

প্রজাপতির পাখনা: মিল-মিছিলের নিদর্শন
প্রজাপতির পাখনার দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? দুটো পাখনার মধ্যে কী সুন্দর মিল! একেবারে পারফেক্ট সামঞ্জস্য (symmetry)!! ফিতের মতো পাখনা দুটো বিভিন্ন প্যাটার্ন, বিন্দু, ও রং-এ চমৎকারভাবে সাজানো। দেখলে মনে হয় যেন কোনো দক্ষ শিল্পীর অপূর্ব শিল্পকর্ম!
প্রজাপতির পাখনা দুটোর দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, দুটো পাখনার রং-এর বিন্যাস অত্যন্ত জটিল। প্রজাপতির পাখনার মতো করে রং-এর বিন্যাস সৃষ্টি করা যে-কোনো দক্ষ চিত্রশিল্পীর পক্ষেও কঠিন হবার কথা। আর যখন দুটো পাখনার ওপর হুবহু একই রকম ডিজাইন করবার প্রশ্ন আসে, তখন তো কথাই নেই। প্রজাপতির দুটো পাখনার ডিজাইন হুবহু একই রকম। দুটো পাখনার ডিজাইনের মধ্যে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম কোনো পার্থক্যও নেই!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এটা কি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, প্রজাপতির দুটো পাখনার প্যাটার্ন হুবহু একই রকম এবং ওই প্যাটার্ন তৈরীর সময় সূক্ষ্মতম কোনো ভুলও করা হয়নি? আপনি পৃথিবীর যে-কোনো একটি জায়গা থেকে যে-কোনো একটি প্রজাপতি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখুন; প্রজাপতির পাখনা দুটোর মধ্যে কোনো অমিল পাবেন না!! পৃথিবীর কোনো শিল্পী যে এ-ডিজাইন করেননি, তা তো ষ্পষ্ট। তাহলে? বস্তুত, যিনি প্রজাপতি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই হচ্ছেন সেই মহান শিল্পী, যিনি শুধু সৃষ্টিই করেননি, সৃষ্টি করেছেনে নান্দনিকভাবে। প্রজাপতির দুটো পাখনার ডিজাইনের মধ্যে অসাধারণ সামঞ্জস্য সৃষ্টি করেছেন সেই মহান স্রষ্টাই।

সবচে লম্বা গলার প্রাণী: জিরাফ
জিরাফের বেশকিছু চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। জিরাফের গলা অসম্ভব লম্বা হলেও, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো জিরাফের ঘাড়েও সর্বমোট সাতটি কশেরুকা আছে! জিরাফ সম্পর্কে আরো একটা চমকপ্রদ সত্য হচ্ছে: খুবই লম্বা গলার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, মাথায় রক্ত সঞ্চালন করতে এর কোনো অসুবিধা হয় না। অথচ একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, একটি প্রাণীর হার্টের পক্ষে অত উঁচুতে রক্ত পাম্প করে তোলা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। কিন্তু জিরাফের এক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় না। কারণ, জিরাফের হার্টের গঠনশৈলীই এমন যে, এটি অনেক উঁচুতে অবস্থিত মাথায় অনায়াসেই পাম্প করে রক্ত তুলতে পারে!
পানি পান করবার সময় অবশ্য জিরাফের সমস্যা হয়। তবে সে-সমস্যা এদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয় না। অথচ, স্বাভাবিক বিচারে তা-ই হবার কথা। জিরাফ যখন এর অস্বাভাবিক লম্বা গলা নীচে নামিয়ে জলাশয় থেকে পানি পান করে, তখন মাথায় অতিরিক্ত রক্তের চাপ পড়বার কথা এবং স্বাভাবিকভাবে সে-চাপের ফলে জিরাফের মৃত্যু হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কারণ, জিরাফের গলার রক্তনালী এমনভাবে তৈরী যে, কোনো সমস্যা হয় না। জিরাফের গলার রক্তনালীতে বিশেষ ধরণের ভাল্ব থাকে। যখন জিরাফ পানি পান করবার জন্য মাথা নীচে নামিয়ে আনে, তখন সেই ভাল্বগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে অতিরিক্ত রক্ত ব্রেনে যেতে দেয় না!
কোনো সন্দেহ নেই যে, জিরাফরা নিজেরা-ই নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করে নেয়নি। না এ-কথা বলা চলে যে, বিবর্তনের মাধ্যমে ও দৈবক্রমে শত শত বছর ধরে জিরাফ এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করেছে। জিরাফের বেঁচে থাকবার জন্য, একটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হার্ট ও ভাল্বসমৃদ্ধ গলা থাকা সবসময়ই জরুরি ছিল। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর একটিও যদি না-থাকে বা কোনো একটি সিস্টেম অসম্পূর্ণ থাকে, তবে জিরাফের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সুতরাং, এটা কল্পনা করা যুক্তিসংগত নয় যে, জিরাফেরা শত শত বছর ধরে ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো (বিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে) অর্জন করেছে। সত্য হচ্ছে, ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো ছাড়া কোনো জিরাফের পক্ষে শত শত বছর তো দূরের কথা, অল্প কিছুদিনও টিকে থাকা সম্ভব নয়।
তাহলে আমরা কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হবো? সিদ্ধান্তটি হচ্ছে: প্রাণীজগতের এই প্রজাতিটি অর্থাৎ জিরাফ এর সৃষ্টির শুরু থেকেই বেঁচে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়েই অস্তিত্বলাভ করেছে। কোনো অনস্তিত্বশীল প্রাণীর পক্ষে নিজের শরীরের গঠনশৈলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহ নির্ধারণ করা বা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। অথচ আমরা দেখছি যে, জিরাফ এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, যে-বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য কোনো প্রাণীর নেই। এতে প্রমাণিত হয় যে, একজন মহান স্রষ্টাই জিরাফের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো সচেতনভাবে সৃষ্টি করেছেন।

সামুদ্রিক কাছিম (Sea Turtles)

সামুদ্রিক কাছিমেরা, প্রজননের সময়, দল বেধে সমুদ্র-সৈকতে হাজির হয়। তবে অবশ্যই যে-কোনো সমুদ্র-সৈকতে নয়! ঠিক যেই সমুদ্র-সৈকতে এদের নিজেদের জন্ম হয়েছিল, সেই সৈকতেই এরা হাজির হয় প্রজননের সময়!! (সূত্র: Maurice Burton, C.B.P.C. Publishing Ltd., Encyclopedia of Animals, Reptiles, p.120) ওই নির্দিষ্ট সৈকতে পৌঁছুতে এদের অনেক সময় ৮০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়! লম্বা এবং কঠিন এই ভ্রমণ তাদেরকে কখনোই লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে না। যে-কোনো পরিস্থিতিতেই এরা এদের জন্মস্থানে এসে উপস্থিত হয় এবং ডিম পাড়ে!!
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, জন্মের পর সংশ্লিষ্ট সৈকত ত্যাগ করবার পর, এরা শুধু প্রজননের সময়ই সেখানে ফিরে আসে; তা-ও ২০ থেকে ২৫ বছর পর! এতোগুলো বছর পূর্বে ছেড়ে-যাওয়া জন্মস্থানের অবস্থান এরা কী করে চিহ্নিত করতে পারে? কী করে এরা পথ খুঁজে পায়? এর সত্যিই কোনো মানবীয় ব্যাখ্যা নেই (সূত্র:  Maurice Burton, C.B.P.C. Publishing Ltd., Encyclopedia of Animals, Reptiles, p.120)।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এরা নির্দিষ্ট সমুদ্র-সৈকতের উদ্দেশ্যে পথ চলে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে। অথচ সমুদ্রের তলদেশে খুব কম আলোই প্রবেশ করে! আবার অসংখ্য একই ধরনের সৈকতের মধ্য থেকে এরা ঠিক চিহ্নিত করতে পারে নিজেদের জন্মস্থানকে!!
কোনো ধরনের কম্পাসের সাহায্য ছাড়াই, সমুদ্রের বিভিন্ন স্থান থেকে, ওরা ঠিক একই সময়ে এসে মিলিত হয় উদ্দিষ্ট সমুদ্র-সৈকতে। প্রাথমিকভাবে এটা একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার। কিন্তু যখন জানা যায় যে, ঠিক কী কারণে এরা একই সময়ে একই সৈকতে এসে হাজির হয় ডিম পাড়বার জন্য, তখন আরো অবাক হতে হয়। সামুদ্রিক কাছিমেরা জানে যে, সামুদ্রিক পরিবেশে এদের শিশু-কাছিমেরা বাঁচতে পারবে না। তাই, এরা সমুদ্রের সৈকতে ডিম পেড়ে সেগুলোকে সৈকতের বালির মধ্যে পুতে রাখে। কিন্তু কেন এরা সকলে একই সৈকতে, একই সময়ে উপস্থিত হয়ে ডিম পাড়ে? ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন সৈকতে ডিম পাড়লে কি শিশু-কাছিমগুলো বাঁচতো না? যে সকল বিশেষজ্ঞ এ-নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা এ-ব্যাপারে পেয়েছেন বিচিত্র সত্যের সন্ধান। বালির নীচে হাজার হাজার শিশু-কাছিমের জন্মের পর (ডিম ভেঙে এরা বেড়িয়ে আসে), এরা সম্মুখীন হয় অনেক প্রতিক’ল পরিস্থিতির। ডিম ভেঙে বেরিয়ে আসবার সময় প্রতিটি শিশু-কাছিমের গড় ওজন হয় মাত্র ৩১ গ্রাম এবং এর একার পক্ষে মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে আাসা অসম্বভব হয়ে যায়। এ-সময়  এরা একে অপরকে মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে! হাজার হাজার শিশু-কাছিম একসঙ্গে মাটি খুঁড়তে শুরু করে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই এরা সৈকতের বালির স্তরের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বালির স্তরের কাছাকাছি পৌঁছেই এরা নিজেদের শরীরকে পুরোপুরি বের করে আনে না! অপেক্ষা করে!! অপেক্ষা করে রাত্রির!!! কেন? অন্যান্য শিকারী প্রাণীর শিকারে পরিণত হবার ভয়ে! এ ছাড়া, সূর্যের আলোতে হামাগুড়ি দিয়ে সমুদ্রের জল পর্যন্ত পৌঁছানোও এদের জন্য কঠিনতর ব্যাপার। তাই ওরা অপেক্ষা করে এবং রাত্রি নামতেই একসঙ্গে বালির স্তর খুঁড়ে বের হয়ে আসে। এরপর, অন্ধকারের মধ্যেই, এরা দ্রুত সমুদ্রের পানে ছোটে এবং সমুদ্রের পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, জন্মস্থান ত্যাগ করবার পর, ২০ থেকে ২৫ বছর পর এরা ফিরে আসে–ডিম পাড়বার জন্য!!

আসুন, আমরা গোটা বিষয়টার প্রতি আরেকবার দৃষ্টি দিই। এই শিশু-কাছিমগুলো কী করে জানলো যে, ডিম ফুটে বের হয়ে আসবার পর, এদেরকে মাটি খুঁড়তে হবে? মাটি খুঁড়ে বালির স্তর পর্যন্ত এসে রাতের জন্য অপেক্ষা করবার উপদেশই বা ওদের কে দিয়ে রেখেছে? কাছাকাছিই শিকারী প্রাণীরা ওত পেতে আছে বা থাকতে পারে–এই তথ্য শিশু-কাছিমগুলোর জানবার কথা নয়। জানলো কী করে? রাত ও দিনের পার্থক্যই বা এরা জানলো কী করে? কখন রাত হচ্ছে, তা-ও তো এদের জানবার কথা নয়! অথচ ঠিকই এরা তা জেনে যাচ্ছে!! কী করে? সূর্যের আলোতে সমুদ্র পর্যন্ত ভ্রমণ করা যে কষ্টকর বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব–তা এরা কীভাবে আঁচ করতে পারে?
এ-সব প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর পেতে হলে, একজন স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার না-করে উপায় নেই। গোটা বিষয়টার কোনো গ্রহণযোগ্য মানবীয় ব্যাখ্যাও দেয়া সম্ভব নয়। এটা ষ্পষ্ট যে, শিশু-কাছিমগুলো জন্মের আগে থেকেই ‘প্রোগ্রামড’ (programmed) হয়ে যায়। এরা তা-ই করে, যা তাদের স্রষ্টা তাদের করতে ইংগিত করেন। সোজা বাংলায় বললে, মহান একজন স্রষ্টাই এদের সৃষ্টি করেছেন এবং এরা জন্মের পর থেকে পুনরায় জন্মস্থানে প্রজননের সময় ফিরে আসা পযন্ত তা-ই করে যা এদের স্রষ্টা চান!

গোবরে পোকা

গোবরে পোকা হচ্ছে এমন একটি মেরুদণ্ডহীন ছোট্ট কীটপতঙ্গ, যাকে নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। গবেষকদের কাছে এই পোকাটি অধিক গুরুত্ব পেয়েছে মূলত এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে। কী সেই বৈশিষ্ট্য? আত্মরক্ষার জন্য এই ক্ষুদ্র পোকাটি রাসায়নিক পদ্ধতি বা chemical methods ব্যবহার করে থাকে!
গোবরে পোকার শরীরের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড (hydrogen peroxide) ও হাইড্রোকুইনোন (hydroquinone) জমা থাকে। বিপদে পড়লে, গোবরে পোকা ওই রাসায়নিক পদার্থ শত্রুর দিকে ছুড়ে মারে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা বেশ জটিল। খুলে বলা যাক। পোকার শরীরের একটি প্রকোষ্ঠে ওই রাসায়নিক পদার্থ দুটোর মিশ্রণ ঘটে। তবে মিশ্রণটি জমা থাকে অন্য একটি প্রকোষ্ঠে (storage chamber)। এই প্রকোষ্ঠটি অন্য একটি প্রকোষ্ঠের (explosion chamber) সঙ্গে যুক্ত থাকে। সাধারণভাবে প্রকোষ্ঠ-দুটো একখণ্ড মাংসপেশি দিয়ে পৃথক করা থাকে। বিপদ দেখলেই গোবরে পোকা সংশ্লিষ্ট পৃথককারী মাংসপেশীকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সরিয়ে দেয় এবং স্টোরেজ চেম্বার থেকে রাসায়নিক পদার্থের আলোচ্য মিশ্রণটি এক্সপ্লোশান চেম্বারে স্থানান্তরিত হয়। এ-সময় এক্সপ্লোশান চেম্বার-এ প্রচণ্ড তাপ ও বাষ্পের সৃষ্টি হয়। সৃষ্ট বাষ্প ও অক্সিজেন এক্সপ্লোশান চেম্বারের ভেতরের দেয়ালে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করে এবং পোকার শরীর থেকে একটি নালার মাধ্যমে রাসায়নিক মিশ্রণটি ছুটে গিয়ে আঘাত করে সংশ্লিষ্ট শত্রুকে। (সূত্র: Michael J. Behe, Darwin’s Black Box, New York: Free Press, 1996, p.232-233)

গোবরে পোকার শরীরে এই রাসায়নিক পদ্ধতি কীভাবে সৃষ্টি হলো? বিবর্তনবাদ দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই একে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ, এই পদ্ধতি ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছর ধরে একটু একটু করে পরিপক্কতা লাভ করেছে এবং অবশেষে আমাদের দেখা গোবরে পোকার মধ্যে পূর্ণতা লাভ করেছে–এমনটি ভাবা অসম্ভব। গোবরে পোকার টিকে থাকবার জন্য গোটা সিস্টেমটি একই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গভাবে অস্তিত্বলাভ করা জরুরি। এবং বাস্তবে হয়েছেও তাই। মোদ্দাকথা, গোবরে পোকার শরীরের ওই বিচিত্র রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যাখ্যা কেবল তখনই দেয়া সম্ভব, যখন স্বীকার করে নেয়া হবে যে, একজন মহান স্রষ্টা আছেন। এই স্রষ্টাই অন্যান্য অসংখ্য সৃষ্টির মতো গোবরে পোকাও সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির সময় একে ‘রাসায়নিক অস্ত্রে সজ্জিত করে দিয়েছেন!

উই-এর বাসা (Termite Nests)

উই-এর বাসা দেখে আশ্চর্য না-হয়ে উপায় নেই। উই-এর প্রতিটি বাসার উচ্চতা পাঁচ থেকে ছয় মিটার। এগুলোকে আর্কিটেকচারাল ওয়ান্ডার (architectural wonders) বলা যেতে পারে। এগুলোর গঠনশৈলী দেখলে যে-কেউ অবাক হতে বাধ্য।
যখন আপনি উই-এর সঙ্গে এর তৈরী বাসার তুলনা করবেন, তখন দেখবেন যে, উই এর শরীরের তুলনায় তিনশত গুণ বড় বাসা তৈরী করেছে! তবে, যে-তথ্যটি এর চেয়েও আশ্চর্যজনক তা হচ্ছে: উই একটি অন্ধ প্রাণী!!
যে কোনোদিন উই-এর বাসা দেখেনি, সে প্রথমে তা দেখলে মনে করবে যে, এটি বালির ওপর বালির স্তর ফেলে কেউ তৈরী করেছে। তবে খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যাবে যে, প্রতিটি উই-এর বাসা ডিজাইন করা হয়েছে চমৎকারভাবে। প্রতিটি বাসার ভেতরে টানেল আছে; করিডোর আছে; ভেন্টিলেশান সিস্টেম আছে; ফাংগাস উৎপাদনের জন্য বিশেষ জায়গা আছে; এবং সর্বোপরি আছে বাসা থেকে বের হয়ে যাবার নিরাপদ পথ!!
আপনি যদি হাজার হাজার অন্ধ মানুষকে সবধরনের কারিগরি সহায়তা প্রদান করেন এবং মাঠে নামিয়ে দেন, তবুও তাঁরা সবাই মিলে উই-এর বাসার মতো একটি কাঠামো তৈরী করতে পারবে না। প্রশ্ন হচ্ছে: কী করে এক থেকে দুই সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট উই অমন চমৎকার বাসা তৈরী করবার আর্কিটেকচারাল ও ইনজিনিয়ারিং জ্ঞান অর্জন করলো? কীভাবে হাজার হাজার অন্ধ উই একসঙ্গে ও সুসমন্বিতভাবে কাজ করে একটি চমৎকার শিল্পকর্ম সম্পাদন করতে পারে? আপনি যদি উই-এর বাসা তৈরীর প্রাথমিক পর্যায়ে বাসাটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন এবং পরে আবার দুটো অংশকে মিলিয়ে দেন, তবে দেখা যাবে যে, বাসার ভেতরের সকল করিডোর, পথ, ও ক্যানালগুলো পরস্পরের সঙ্গে যথাযথভাবে ফিট করছে! কীভাবে এই অলৌকিক ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা চলে?
উই-এর উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করলে এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হতে হবে যে, স্রষ্টা সকল জীবিত প্রজাতিকে অনন্য সৃষ্টি হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। উই-এর একটি বাসাই স্রষ্টাকে উপলব্ধি করবার জন্য যথেষ্ট; উই-এর একটি বাসার অপূর্ব ডিজাইন দেখলেই একজনের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা সহজ হবার কথা যে, একজন মহান স্রষ্টাই সবকিছু পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেছেন।

কাঠঠোকরা

কাঠঠোকরারা গাছের কাণ্ডে, নিজেদের ঠোঁট বা চঞ্চু দিয়ে, গর্ত করে বাসা তৈরী করে থাকে। এ-সত্যটি অধিকাংশ মানুষই জানে। কিন্তু যা অধিকাংশ মানুষ খেয়াল করে দেখে না, তা হচ্ছে: কাঠঠোকরা চঞ্চু দিয়ে গাছের শক্ত কাণ্ডে অবিরাম ঠোকর দেয় এবং সেখানে গর্ত তৈরী করে; অথচ এতে ব্রেনে রক্তক্ষরণ হয়ে এর মৃত্যু হয় না! গর্ত করবার সময় কাঠঠোকরা যা করে, তাকে তুলনা করা চলে একজন মানুষের মাথা দিয়ে ঠুকিয়ে দেয়ালে পেরেক ঢোকানোর সঙ্গে! কোনো মানুষ যদি বাস্তবে অমন কোনো কাজ করতে যায়, তবে সে নির্ঘাৎ মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। অথচ, একটি কাঠঠোকরা তার চঞ্চু দিয়ে একটা গাছের শক্ত কাণ্ডের ওপর দুই থেকে তিন সেকেণ্ডে ৩৮ থেকে ৪৩ বার ঠোকর দেয় এবং এতে তার কোনো ক্ষতিই হয় না! (সূত্র: Grzimeks Tierleben Vogel 3, Deutscher Taschen Buch Verlag, Oktober 1993, p.92)

কাঠঠোকরার কিছু হয় না, কারণ কাঠঠোকরার মাথা এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে সে এমন ধারা কাজ করতে পারে অনায়াসে! কাঠঠোকরার মাথার খুলি বিশেষভাবে তৈরী। ফলে, গাছের কাণ্ডে ঠোকর দেয়ার ফলে যে তীব্র বিপরিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা কাঠঠোকরার মাথা সহজেই সয়ে নিতে পারে। কাঠঠোকরার কপাল এবং এর চঞ্চু ও চোয়ালের লাগোয়া খুলির কিছু মাংসপেশী এমন শক্ত যে, সেগুলো গর্ত খুঁড়বার সময় সৃষ্ট তীব্র বিপরিতমূখী বলের প্রতিক্রিয়াকে অনেক সহনীয় করে দেয়। (সূত্র: Grzimeks Tierleben Vogel 3, Deutscher Taschen Buch Verlag, Oktober 1993, p.89)
এখানেই শেষ নয়। সাধারণভাবে, কাঠঠোকরারা বাসা তৈরী করবার জন্য পাইন গাছ পছন্দ করে থাকে। কোনো কোনো প্রজাতির কাঠঠোকরা তো আবার একশত বছরের অধিক বয়সের পাইন গাছ পছন্দ করে থাকে! কারণ, একশত বছরের পুরাতন পাইন গাছের এক ধরনের বিশেষ রোগ হয় এবং সেই রোগ গাছের শক্ত ও পুরু বাকলকে অপেক্ষাকৃতভাবে নরম করে দেয় (আর নরম কাণ্ডে গর্ত করা সহজতর!)। এ-সত্য অতিসাম্প্রতিককালে বিজ্ঞান জানতে পেরেছে এবং সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো আপনিও এ-সত্য সম্পর্কে অবহিত হলেন! অথচ, কাঠঠোকরারা শত শত বছর ধরে এ-সত্য সম্পর্কে অবগত ছিল এবং আছে!!
বাসা তৈরী করবার জন্য পাইন গাছ পছন্দ করবার আরো কারণ আছে। কাঠঠোকরারা তাদের বাসার চারিপাশে ছোটো ছোটো গর্ত তৈরী করে থাকে। এই গর্তগুলোর কাজ সম্পর্কে আগে কোনো কিছুই জানা ছিল না। পরে গবেষকরা বুঝতে পারলেন যে, আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ ওই গর্তগুলো আসলে কাঠঠোকরাদের বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করে! কীভাবে? গর্তগুলো কালে পাইন গাছের কাণ্ড থেকে  নিঃসৃত আঠালো রস দিয়ে পূর্ণ হয় এবং রসপূর্ণ সেই গর্তগুলোই কাঠঠোকরার বাসার দূরবর্তী ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে। এ-ঘাঁটিগুলো কাঠঠোকরাকে সাপের কবল থেকে রক্ষা করে! উল্লেখ্য, সাপ হচ্ছে কাঠঠোকরার প্রধান শত্রু।
কাঠঠোকরার দেহের বৈচিত্র্যময় কাঠামোর আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। জিহ্বার কথাই ধরা যাক। কাঠঠোকরার জিহ্বা এতো সরু যে, এটি গাছের গায়ে তৈরী পিঁপড়ার বাসার ভেতরে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এদের জিহ্বা আঠাযুক্তও বটে। ফলে, এরা জীবন্ত পিঁপড়া ধরতে পারে অনায়াসে। তা ছাড়া, কাঠঠোকরার জিহ্বা এমনভাবে গঠিত যে, পিঁপড়ার দেহাভ্যন্তরের এসিড সে-জিহ্বার কোনো ক্ষতি করতে পারে না!! (সূত্র: Grzimeks Tierleben Vogel 3, Deutscher Taschen Buch Verlag, Oktober 1993, p.87-88)

ওপরে কাঠঠোকরাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হলো। কাঠঠোকরাদের দৈহিক গঠনশৈলী কি প্রমাণ করে না যে, এরা একজন মহান স্রষ্টার পরিকল্পিত সৃষ্টি? কাঠঠোকরারা যদি দৈবক্রমে বিবর্তিত হতো–যেমনটি বিবর্তনবাদ দাবী করে–তবে এই বিশেষ প্রজাতিটি কবেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। যেহেতু স্রষ্টা এদের নির্দিষ্ট গুণাবলীসম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন, এরা সবগুলো গুণ একত্রে নিয়ে শত শত বছর ধরে প্রকৃতির প্রতিকূল পরিবেশে দিব্যি টিকে আছে।

ছদ্মবেশ (Camouflage)

পশুপাখীরা নানান কৌশলে শত্র“র কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করে থাকে। ‘ছদ্মবেশ’ তেমনই একটি কৌশল। কোনো কোনো প্রাণীর গায়ের গঠন ও রঙ এমন যে, এরা তাদের আশেপাশের গাছপালার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে থাকে বা থাকতে পারে। আশপাশের পরিবেশ এবং গাছপালার সঙ্গে ওদের গায়ের রঙ এমনভাবে একাকার হয়ে যায় যে, স্বাভাবিকভাবে দেখলে এদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা মুশকিল; এরা প্রাণী না উদ্ভিদ–বোঝা দায়!
আমরা এমন একটি পতঙ্গের কথা জানি, যে-পতঙ্গের শরীরের সঙ্গে একটি উদ্ভিদের পাতার হুবহু মিল থাকায়, সে শত্র“র চোখকে কী সহজেই ফাঁকি দিতে পারে! এটা তো ষ্পষ্ট যে, ওই ক্ষুদ্র পতঙ্গটি ওর নিজের শরীরকে গাছের পাতার মতো করে নিজেই তৈরী করেনি। সম্ভবত পতঙ্গটি এ-সত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর হয়েই আছে যে, নির্দিষ্ট একটি গাছের পাতার সঙ্গে তার শরীরের চমৎকার মিল থাকবার কারণে, সে শত্র“র কবল থেকে প্রতিনিয়ত বেঁচে যাচ্ছে! তাহলে কে এ-চমৎকার ডিফেন্স সিস্টেমটি সৃষ্টি করেছেন? একটি দক্ষ পরিকল্পনা ছাড়া এ-ধরনের ডিফেন্স সিস্টেম বা প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা কি একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর শরীরে গড়ে ওঠা সম্ভব? বস্তুত, পর্যবেক্ষকরা যখন বিষয়টি সম্পর্কে ষ্পষ্ট ধারণা অর্জন করেন, তখন তাদের মনে এ-ধারণা সৃষ্টি হতে বাধ্য যে, একজন মহান ও দক্ষ স্রষ্টা-ই গোটা বিষয়টির পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী।

মিথ্যা চোখ (False Eyes)

প্রাণীজগতে কিছু চমৎকার ও অকল্পনীয়ভাবে কৌতুহল-উদ্দীপক ‘ডিফেন্স সিস্টেম’ বা প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই। ‘মিথ্যা চোখ’ তেমনই একটি ব্যবস্থা। কোনো কোনো ধরনের প্রজাপতি, শুঁযা পোকা, ও কিছু জাতের মাছ তাদের ‘মিথ্যা চোখ’ দেখিয়ে শত্রুদের মনে ভয় জাগায় বা জাগাতে পারে। ‘মিথ্যা চোখ’ প্রদর্শন করে এরা নিজেদেরকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে জাহির করতে পারে।
একধরনের প্রজাপতি আছে যারা শত্রুর উপস্থিতি টের পেলেই, নিজেদের দুই পাখনার ওপর দুইজোড়া ‘মিথ্যা চোখ’ প্রদর্শন করে। গোটা ব্যাপারটা শত্র“র জন্য একটা আপাত হুমকি সৃষ্টি করে এবং ভয়ে শত্র“ তাকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকে!
এখন আসুন গোটা বিষয়টা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করি: ‘মিথ্যা চোখ’ সৃষ্টির ওই কায়দা কি এমনি এমনি বা দৈবক্রমে প্রজাপতির প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে? কীভাবেইবা ওই প্রজাপতি এটা জানলো যে, বিশেষভাবে নিজের পাখনা দুটো মেলে ধরলে, দুটো ‘মিথ্যা চোখ’ দৃষ্টিগোচর হবে এবং তা শত্র“কে ভয় পাইয়ে দিয়ে তাকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখবে? প্রজাপতিটি কি নিজেই নিজের পাখনার ওপরের ‘মিথ্যা চোখ’ আবিস্কার করবার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ওই চোখ দেখিয়ে শত্রুকে ভয় দেখানো সম্ভব?
সত্যি কথা বলতে কি, এ-ধরনের ঘটনা দৈবক্রমে ঘটতে পারে না। প্রজাপতির পাখনার ওপরের অমন আশ্চর্য ডিজাইন দৈবক্রমে সৃষ্টি হতে পারে না। এ এক মহান স্রষ্টার  সচেতন পরিকল্পনারই ফসল। তা ছাড়া, এমনটি কল্পনা করা সম্ভব নয় যে, প্রজাপতি নিজেই তার পাখনার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা জেনেছে এবং জানবার পরেই কেবল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, অতঃপর সে শত্র“কে ভয় দেখানোর জন্য একে ব্যবহার করবে। এটা ষ্পষ্ট যে, যিনি প্রজাপতিকে সৃষ্টি করেছেন–সেই মহান স্রষ্টাই প্রজাপতিকে ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্যসহকারে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে তা ব্যবহার করে শত্রুকে ভয় দেখানোর কায়দা-কানুনও শিখিয়ে দিয়েছেন!

ওয়াটার লিলি (Water Lilies)

পৃথিবীতে কতো বিচিত্র ধরনের ফুল আছে! প্রতিনিয়ত আমরা এসব ফুল ফুটতে দেখি এবং আমাদের মনে এ-নিয়ে কোনো প্রশ্নের উদয় হয় না। অথচ এসব ফুল কতো সুন্দর ও নিখুঁত! কীভাবে এগুলো সৃষ্টি হলো? কে সৃষ্টি করলো? না, স্বাভাবিকভাবে এ-ধরনের কোনো প্রশ্ন আমাদের মনে উদয় হয় না। ফুল এবং ফুল-এর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলে যে-কেউ এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে যে, এ-সবই এক মহান স্রষ্টার সৃষ্টির অংশ। কিন্তু এখানে আমরা কোনো সাধারণ ফুল নিয়ে আলোচনা করবো না। আমরা আলোচনা করবো এমন একটি বিশেষ ফুল এবং সে-ফুলের গাছ নিয়ে, যে-গাছ জন্মে বিশেষ পরিবেশে। আশা করি এ-আলোচনা থেকে স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
আমাজান ওয়াটার লিলি-র কথাই ধরুন। এই উদ্ভিদের জন্মের শুরুটা হয় আমাজান নদীর তলদেশের কাদামাটিতে! জন্মের পর এরা ঊর্ধমূখী হয়ে পৌঁছে যায় নদীর পানির উপরিভাগে। জন্মের পর থেকেই এদের লক্ষ্য থাকে সূর্যালোকের নাগাল পাওয়া। কারণ, সূর্যালোক এদের টিকে থাকবার জন্য জরুরি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পানির উপরিভাগে পৌঁছুবার সঙ্গে সঙ্গে এদের ঊর্ধমূখী বৃদ্ধি একদম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এরা কাটাওয়ালা ও গোলাকৃতির মুকুল উৎপাদন করতে শুরু করে এবং মুকুলগুলো ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই বিশালাকৃতির পাতায় রূপান্তরিত হয়। পাতাগুলোর বিস্তার হয় দুই মিটারের মতো! এরা ‘জানে’ যে, প্রচুর পাতা সৃষ্টির মাধ্যমে নদীর উপরিভাগের যতো জায়গা দখল করা যাবে, ততোই মঙ্গল। প্রচুর পাতার মাধ্যমে এই ওয়াটার লিলিরা পর্যাপ্ত সূর্যালোক গ্রহণ করে এবং সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করে। এরা ‘জানে’ যে, তা না-হলে নদীর তলদেশে সূর্যালোকের অনুপস্থিতিতে টিকে থাকা সম্ভব নয়!
আবার, টিকে থাকবার জন্য ওয়াটার লিলির শুধু সূর্যালোক হলেই চলে না। সমানভাবে এদের চাই অক্সিজেনও। অথচ, নদীর তলদেশের কাদাময় ভূমির গভীরে প্রথিত থাকে এদের শিকড়। ওখানে কোনো অক্সিজেনের বালাই নেই। ফলে, ওদের শিকড় সেখান থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারে না। তাহলে? কী করে টিকে থাকে ওরা? এ-সমস্যা সমাধানের জন্য ওয়াটার লিলির আছে শিকড় থেকে নদীর উপরিভাগে অবস্থিত পাতা পর্যন্ত বিশেষধরনের লম্বা কাণ্ড। এ নলাকৃতির কাণ্ডের দৈর্ঘ্য কখনো কখনো ১১ মিটার পর্যন্ত হয়। এ-কাণ্ড ওয়াটার লিলির শিকড় ও পাতার মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করে এবং পাতা থেকে শিকড় পর্যন্ত অক্সিজেন বহনের জন্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করে! (সূত্র: David Attenborough, The Private Life of Plants, Princeton University Press, 1995, p.291)

নদীর তলদেশে, জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে, কীভাবে একটি কুঁড়ি জানতে পারলো যে, বেঁচে থাকবার জন্য এর অক্সিজেন ও সূর্যালোক প্রয়োজন? কীভাবেইবা এর পক্ষে জানা সম্ভব যে, টিকে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও সূর্যালোক পাওয়া যাবে নদীর উপরিভাগে? অথচ, স্বাভাবিকভাবেই, সদ্য জন্ম-নেয়া একটি শিশু-উদ্ভিদের পক্ষে এটা জানা সম্ভব নয় যে, ওপরে নদীর পানি একস্থানে গিয়ে শেষ হয়েছে। অক্সিজেন ও সূর্যালোকের অস্তিত্ব সম্পকের্ও এর কোনো ধারণা থাকবার কথা নয়। তাহলে গোটা ব্যাপারটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এ তো ষ্পষ্ট যে, বিবর্তনবাদ দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বিবর্তনবাদ অনুসারে, ওয়াটার লিলির জীবনচক্রের অতোসব জটিলতা একসঙ্গে অস্তিত্বে আসা সম্ভব নয়। অথচ, টিকে থাকতে হলে, ওয়াটার লিলির জীবনচক্রের গোটা প্রক্রিয়াটাই একসঙ্গে ঘটা চাই! এক্ষেত্রে, ধীরে ধীরে সরল থেকে জটিল অবস্থায় উপনীত হবার কোনো সুযোগ ওয়াটার লিলির নেই। তাহলে মানতেই হচ্ছে যে, একজন মহান স্রষ্টাই ওয়াটার লিলিকে এর জীবনচক্রের সকল জটিলতাসহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার ইশারাতেই এর জন্ম এবং আশ্চর্যজনকভাবে টিকে থাকা!
ওয়াটার লিলির অবিশ্বাস্য জীবনযুদ্ধের এটাই পুরো চিত্র নয়। এর পাতাগুলোর প্রান্তভাগ এমনভাবে কোঁকড়ানো থাকে যাতে এগুলো পানিতে ডুবে না-যায়! কার ইঙ্গিতে এমনটি ঘটে থাকে? খানিকটা চিন্তা করলেই যে-কোনো বিবেকবান মানুষ বলে উঠবেন: মহান স্রষ্টার ইঙ্গিতে!!
ওয়াটার লিলির জীবনচক্রের আরেকটি আশ্চর্যজনক পর্যায় হচ্ছে এর পরাগায়ন-প্রক্রিয়া। ওয়াটার লিলির পরাগায়ন-প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে একধরনের গোবরে পোকা। এই গোবরে পোকা-ই এক ওয়াটার লিলি থেকে অন্য ওয়াটার লিলি পর্যন্ত পরাগরেণূ বহন করে নিয়ে যায় এবং ওয়াটার লিলির প্রজননে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গোবরে পোকাগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এগুলো সাদা রং-এর প্রতি দুর্বল। আমাজান নদীতে জন্ম-নেয়া অন্য সকল আকর্ষণীয় ফুলের মধ্যে এদের পছন্দ কেবল ওই সাদা ওয়াটার লিলিকেই!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাজন লিলির সাদা রং-এ আকৃষ্ট হয়ে পোকাগুলো কাছে এলেই, ফুলগুলো পোকাগুলোকে ‘বন্দী’ করে ফেলে এবং পোকাগুলোর গায়ে পর্যাপ্ত পরাগরেণূ লাগতে দেয়। এর জন্য পোকাগুলোকে পুরো একটি রাত ‘বন্দী’ থাকতে হয়! আরো আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, পোকাগুলোকে মুক্ত করে দিয়েই, আমাজান লিলি তার ফুলের রং পরিবর্তন করে ফেলে! সাদা আমাজন লিলি হয়ে যায় গোলাপী!! কেন? যাতে পরাগরেণূসমেত মুক্ত পোকাগুলো পুনরায় এমুখো না হতে পারে!! নিজের রং পরিবর্তন করবার মাধ্যমে, আমাজান লিলি তার নিজের পরাগরেণূ দ্বারা মাখামাখি-হয়ে-যাওয়া গোবরে পোকার পুনরাগমনের পথ সুনিপূণ কৌশলে বন্ধ করে দেয়!! পরাগরেণুসমেত গোবরে পোকা তখন অন্য আমাজনের সাদা ফুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেখানে যায় এবং পরাগায়নের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।

প্রশ্ন হচ্ছে: এটা কি সম্ভব যে, আমাজান লিলির কুঁড়ি নিজেই অমন জটিল ও নিখুঁত জীবনচক্রের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে? নিশ্চয়ই না! আসলে এ সেই মহান স্রষ্টার জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ মাত্র, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। অন্যান্য সৃষ্টির মতো, ওয়াটার লিলিকেও মহান স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন এবং এর জীবনচক্রকে দিয়েছেন বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য। তার মহান পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই নদীর তলদেশের কাদামাটিতে আমাজন ওয়াটার লিলির জন্ম এবং তার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এর বিচিত্র জীবনের পথচলা। ওই বিশেষ ধরনের গোবরে পোকাও তারই সৃষ্টি। এ সবকিছুই মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের স্মারক।

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে স্রষ্টার অস্তিত্ব
বিজ্ঞান এ-বিশ্বজগত ও বিশ্বজগতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন জীব ও জড় সম্পর্কে যে-সত্য আবিস্কার করেছে, সে-সত্যের খানিকটা নিয়ে আমরা ওপরে আলোচনা করেছি এবং দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, ওসব সত্য আমাদেরকে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে উদ্ধুদ্ধ করে। বস্তুত, বিজ্ঞান আমাদেরকে এ-সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করে যে, এ-বিশ্বজগতের একজন স্রষ্টা আছেন– যিনি ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানের দিক দিয়ে একদম নিখুঁত বা পারফেক্ট। এই মহান স্রষ্টা সম্পর্কে জানবার পথ বাৎলে দেয় ধর্ম। সুতরাং এ-কথা বলা চলে যে, ধর্মের বর্ণনাকৃত সত্যকে ভালোভাবে উপলব্ধি করবার এবং যাচাই করবার একটি পদ্ধতি হচ্ছে বিজ্ঞান।
তবে, আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে, সংখ্যায় কম হলেও, একদল আছেন যারা মনে করেন যে, বিজ্ঞান আর ধর্ম পরস্পরবিরোধী । তারা আরো প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন যে, বিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত ও সত্য দিয়ে স্রষ্টাকে আবিস্কার করা যাবে না।

বাস্তবতা হচ্ছে, নিকট অতীতেও বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ ছিল না। মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেও, বিজ্ঞান ও ধর্ম হাত ধরাধরি করে চলেছে এবং তখন স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে বিজ্ঞানকে একটিা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে মনে করা হতো। আমরা আজকে বিজ্ঞানের যে-নাস্তিক্যবাদী ধারাটির অস্তিত্ব লক্ষ্য করছি, তার উৎপত্তি অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সে-সময়ে বিজ্ঞানের জগতে বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা শিকড় গেড়ে বসে। বিশেষ করে, ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন বিবর্তনবাদ প্রচার করবার পর, বস্তবাদী বিজ্ঞানীরা ধর্মের বিকল্প হিসেবে বিবর্তনবাদকে লুফে নেয়। উল্লেখ্য, বিবর্তনবাদ অনুসারে, এ-বিশ্বজগত সৃষ্টির পেছনে কোনো স্রষ্টার হাত নেই; এ-বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে দৈবক্রমে বা এমনি এমনি। ফলে, এটা প্রচার করা হতে লাগলো যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ একটি প্রমাণিত বিষয়। ব্রিটিশ গবেষক মাইকেল বাইজেন্ট (Michael Baigent), রিচার্ড লেইগ (Richard Leigh), ও হেনরি লিনকন (Henry Lincoln) গোটা বিষয়টার ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন:
“ডারউইনের দেড় শতাব্দী আগে, স্যার আইজাক নিউটনের কাছে বিজ্ঞান ধর্ম থেকে আলাদা কোনো কিছু ছিল না। তখন বরং বিজ্ঞানকে ধর্মেরই একটা অংশ মনে করা হতো এবং বিশ্বাস করা হতো যে, বিজ্ঞান ধর্মের অনুগত বা অধীন একটি বিষয়। …কিন্তু ডারউইনের সময়কার বিজ্ঞান তার পূর্বপরিচয় হারায় এবং বিজ্ঞানকে ধর্মের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়…। ফলে, বিজ্ঞান ও ধর্ম পরস্পরবিরোধী দুটি বিষয়ে পরিণত হয় এবং মানুষের সামনে দুটোর একটাকে বেছে নেয়ার চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে।”–(সূত্র: Michael Baigent, Richard Leigh, Henry Lincoln, The Messianic Legacy, Gorgi Books, London,1991, p.177-178)

যেমনটি আগে উল্লেখ করেছি, বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে তথাকথিত বিভাজন ছিল পুরোপুরিভাবেই আদর্শিক। বস্তুবাদে বিশ্বাসী একদল বিজ্ঞানী শুরু থেকেই চেষ্টা করছিলেন এটা প্রমাণ করতে যে, এ-বিশ্বজগতের কোনো স্রষ্টা নেই। তারা এ-লক্ষ্যে বেশকিছু থিওরিও প্রণয়ন করেছিলেন। ‘বিবর্তনবাদ’ সেগুলোর মধ্যে সবচে বিখ্যাত ও সবচে গুরুত্বপূর্ণ। তখন জ্যোতির্বিজ্ঞানের ফিল্ড-এও কয়েকটি তত্ত্ব অস্তিত্বলাভ করে। ‘স্টেডি-স্ট্যাট থিওরি’ (steady-state theory), ও ‘গোলমাল তত্ত্ব’ (chaos theory)  তেমনি দুটো তত্ত্ব। তবে, স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকারকারী ওই সকল তত্ত্বকে স্বয়ং বিজ্ঞানই ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করে ছেড়েছে; আমরা ইতিমধ্যে সে-বিষয় নিয়ে আলোচনাও করেছি।
এ-কথা সত্য যে, আজও এমন একদল বিজ্ঞানী আছেন, যারা ধর্মের ‘অসারত্ব’ প্রমাণে সর্বদা সচেষ্ট আছেন এবং যারা স্রষ্টার অস্তিত্বকে যে-কোনো মূল্যে অস্বীকার করতে বদ্ধপরিকর। এ ধরনের বিজ্ঞানীরা আজো ওই সকল অপ্রমাণিত তত্ত্ব বা থিওরিকে আঁকড়ে ধরে আছেন। তারা যেন পণ করেই বসে আছেন যে, যা-ই ঘটুক না কেন, স্রষ্টাকে বিশ্বাস করা যাবে না! এখানে প্রখ্যাত ইংরেজ প্রাণীবিজ্ঞানী ও বিবর্তনবাদী ডি.এম.এস. ওয়াটসন-এর একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়। তিনি সে-উক্তিতে তিনি এবং তার সমর্থকরা কেন বিবর্তনবাদকে গ্রহণ করে নিয়েছেন তা স্বীকার করেছেন। উক্তিটি হচ্ছে:
“…বিবর্তনবাদকে বিশ্বব্যাপী গ্রহণ করে নেয়া হয়েছে এ-জন্য নয় যে, এ-তত্ত্বকে সত্য বলে প্রমাণ করবার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে; বরং একে সত্য বলে গ্রহণ করা হয়েছে এ-জন্য যে, এ-তত্ত্বের একমাত্র বিকল্প হচ্ছে ‘বিশেষ সৃষ্টি’ (তত্ত্ব)–যা সুষ্পষ্টভাবেই অগ্রহণযোগ্য।”-(সূত্র: D.M.S. Watson, “Adaptation”, Nature,no.124, p.233)

‘বিশেষ সৃষ্টি’ বলতে ওয়াটসন বুঝিয়েছেন আল্লাহর সৃষ্টিকে। এ-বিশ্বজগত ও এর অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল জীবিত বস্তুকে আল্লাহ বা স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন–এমন কথা ওই বিজ্ঞানীর কাছে ‘অগ্রহণযোগ্য’। কেন অগ্রহণযোগ্য? না, এ-কারণে নয় যে, বিজ্ঞান একে অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়ে বসে আছে। বিজ্ঞান তো বরং ‘বিশেষ সৃষ্টি’-র পক্ষেই তথ্য-উপাত্ত হাজির করে চলেছে! আসলে ‘বিশেষ সৃষ্টি’ এবং ওই বিশেষ সৃষ্টির পেছনে ক্রিয়াশীল একজন মহান স্রষ্টার অস্তিত্বকে ওয়াটসনের মতো একদল বিজ্ঞানীর কাছে ‘অগ্রহণযোগ্য’ এ-কারণে যে, তারা একজন স্রষ্টার অস্তিত্বকে কোনো অবস্থাতেই স্বীকার করে নিতে রাজী নন। বস্তুত, সকল বিবর্তনবাদীর অবস্থাই ওই একই রকম। তারা বিবর্তনবাদের প্রতি কমিটেড।
বিবর্তনবাদকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করবার জন্য, বিবর্তনবাদীরা বিজ্ঞানের ওপর নয় বরং নির্ভর করে বস্তুবাদী দর্শনের ওপর। বস্তুবাদী দর্শনের যুক্তিকে বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করবার জন্য, তারা বিজ্ঞানকে বিকৃত করতেও পিছপা হন না কখনো-সখনো। জেনেটিকবিদ্যার ওপর বিশেষজ্ঞ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কট্টর বিবর্তনবাদী রিচার্ড লিওনটিন এ-সত্য স্বীকার করেছেন এভাবে:
“এ-বিশ্বজগতের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা গ্রহণ করে নিতে বিজ্ঞান আমাদের বাধ্য করে না। কিন্তু বস্তুবাদের প্রতি দুর্বলতাই আমাদের বাধ্য করছে বিশ্বজগতের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে–তা সে-ব্যাখ্যা যতোই অযৌক্তিক বা জ্ঞানবুদ্ধি-বিরোধী হোক না কেন। তা ছাড়া, বস্তুবাদ হচ্ছে অ্যাবসলুট (absolute); তাই আমরা কোনো ‘স্বর্গীয় পা’-এর (Divine Foot) চিহ্ন আমাদের ‘দরজা’-র সামনে পড়তে দিতে পারি না।”–(সূত্র: Richard Lewontin, ‘Billions and Billions of Demons’, New York Review of Books, January 9, 1997, p.28)

অন্যদিকে, আজকে, বস্তুবাদী বিজ্ঞানীদের বিপরীতে, এমন অসংখ্য বিজ্ঞানীও আছেন, যারা একজন স্রষ্টার।অস্তিত্বকে স্বীকার করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, স্রষ্টাকে জানবার অন্যতম উপায় হচ্ছে ‘বিজ্ঞান’। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী মহলে তাই আজকাল ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’ (creationism) বা ‘জ্ঞানসম্পন্ন ডিজাইন’ (Intelligent Design) নামক তত্ত্ব বেশ দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বসেছে। এসব তত্ত্বের পক্ষে বিজ্ঞান ইতোমধ্যেই যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেশ করেছে। এ-তত্ত্ব অনুসারে, বিশ্বজগতের সকল জীবিত বস্তু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে সৃষ্টি করেছেন একজন মহাক্ষমতাধর স্রষ্টা।
দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞান ও ধর্ম দুটি পরস্পরবিরোধী তথ্য-উৎস নয়। ধর্ম যে পরম সত্যের কথা প্রকাশ করে, বিজ্ঞান তা-ই পরখ করে দেখবার একটা পদ্ধতি মাত্র। তবে হ্যা, কোনো কোনো ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ থাকতে পারে বা আছেও। সে-সব ধর্মের ধর্মীয় পুস্তকে স্রষ্টার বাণীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে মানুষের মনগড়া অনেক তথ্য-উপাত্ত। তাই সে-সব ধর্মের সঙ্গে অতীতেও বিজ্ঞানের বিরোধ দেখা গেছে এবং এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও দেখা দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, ইসলাম এই দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। কারণ, ইসলামের মূল উৎস আল-কুরআন সম্পূর্ণভাবে খোদায়ী বাণীর সমষ্টি। এটাতে কোনো মানুষের রচিত কোনো তথ্য বা কথা নেই। তা ছাড়া, ইসলাম বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। ইসলাম বলে যে, এ-বিশ্বজগতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মহান স্রষ্টার অসংখ্য নিদর্শন। সে-সব নিদর্শন নিয়ে কুরআন বারবার মানুষকে গবেষণা করতে নির্দেশ দেয়। বস্তুত কুরআনের এক অষ্টমাংশ অংশ  জুড়ে আছে বিজ্ঞান-সম্পর্কিত আয়াত। তেমনি কয়েকটি আয়াতে বলা হচ্ছে:
“তাহারা কি তাহাদের ঊর্ধ্বস্থিত আকাশের দিকে তাকাইয়া দেখে না, আমি কিভাবে উহা নির্মাণ করিয়াছি এবং উহাকে সুশোভিত করিয়াছি  ও উহাতে কোনো ফাটলও নাই? আমি বি¯তৃত করিয়াছি ভূমিকে ও উহাতে স্থাপন করিয়াছি পর্বতমালা এবং উহাতে উদ্গত করিয়াছি নয়নপ্রীতিকর সর্বপ্রকার উদ্ভিদ। …আকাশ হইতে আমি বর্ষণ করি কল্যাণকর বৃষ্টি এবং তদ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান ও পরিপক্ক শস্যরাজি; (সৃষ্টি করি) সমুন্নত খর্জুর বৃক্ষ–যাহাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর…”–(আল কুরআন; সুরা ক্বাফ; আয়াত:৬,৭,৯,১০)

ওপরের আয়াতগুলোতে যেমন বলা হয়েছে, কুরআন সর্বদা মানুষকে চিন্তা-গবেষণা করতে বলে এবং যে-পৃথিবীতে তাদের বসবাস–সেই পৃথিবীর সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য তাগিদ দেয়। কারণ, বিজ্ঞান সত্যধর্মকে সমর্থন করে এবং মানুষকে অজ্ঞতা থেকে রক্ষা করে; বিজ্ঞান মানুষকে চিন্তা-রাজ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করে এবং বিশ্বজগতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্রষ্টার অসংখ্য নিদর্শন সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।

প্রখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক বলছেন:
“যে-ব্যাক্তি সত্যিকার অর্থেই বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, সে-ব্যাক্তি মর্মে মর্মে  উপলদ্ধি করে যে, ‘বিজ্ঞান’ নামক মন্দিরের প্রবেশ পথের তোরণে লেখা আছে: ‘তোমাকে অবশ্যই বিশ্বাসী হতে হবে’। এটি (অর্থাৎ বিশ্বাস) এমন একটা গুণ–যা ছাড়া কোনো বিজ্ঞানী চলতে পারে না।”-(সূত্র: Max Planck, Where is science going?, Allen & Unwin, 1933, p.214)

আমরা এ-পর্যন্ত যা-কিছু আলোচনা করলাম, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এ-বিশ্বজগত ও এর অভ্যন্তরে অবস্থিত অসংখ্য জীবিত বস্তুর অস্তিত্বকে স্রেফ ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করবার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী এ-সত্যকে আগেও স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এখনো নিচ্ছেন। মানুষ যতোই এই বিশ্বজগত সম্পর্কে জানতে পারছে, ততোই সে এর সৃষ্টির অসাধারণ নিপূণতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। এ-বিশ্বজগত সম্পর্কে প্রতিদিন ক্ষুদ্র থেকে বড়–যা কিছুই আবিস্কার হচেছ, তা স্রষ্টার অস্তিত্বকেই কেবল আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
সত্যি কথা বলতে কি, আধুনিক পদার্থবিদদের একটা বড় দল স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্টির ধারণাকে সত্য বলেই মেনে নিয়েছেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার দিকপালদের প্রায় সবাই স্রষ্টায় বিশ্বাস করতেন; বিশ্বাস করতেন আসমানী কিতাবে। ইতিহাসের বিখ্যাত যে-সব পদার্থবিদ স্রষ্টায় বিশ্বাস করতেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন: স্যার আইজাক নিউটন, ফ্যারাডে, ক্যালভিন, ও ম্যাক্সওয়েল।
আইজাক নিউটনের সময়ে, বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও পদার্থবিদরা বিশ্বাস করতেন যে, গ্রহসমূহ ও আসমানী বস্তুসমূহের গতি-প্রকৃতিকে ভিন্ন ভিন্ন সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। কিন্তু নিউটন বিশ্বাস করতেন যে, যেহেতু পৃথিবী ও মহাশূন্যের স্রষ্টা একই জন, সেহেতু এদেরকে একই সূত্র বা Law দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। তিনি লিখেছেন:
“ সূর্য, গ্রহসমূহ এবং ধূমকেতুসমূহের এই সুন্দর সিস্টেমটি কেবল একজন বুদ্ধিমান ও ক্ষমতাবান সত্ত্বার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই চালু থাকা সম্ভব।”–(সূত্র: Newton, Principia, 2nd Edition; J. De Vries, Essentials of Physical Science, B.EerdmansPub.Co., Grand Rapids, SD, 1958, p.15৫)

মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে-সব বিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যা, গণিত, ও জ্যোতির্বিদ্যার জগতে গবেষণা করেছেন, তাদের মধ্যে হাজার হাজার বিজ্ঞানী এ-সত্য সম্পর্কে একমত যে, এ-বিশ্বজগত একজন একক স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্ট। বিখ্যাত বিজ্ঞানী জোহানেস ক্যাপলার (Johannes Kepler, the founder of physical astronomy) তার সে-বিশ্বাসের কথা, কোনোরকম রাখডাক না-করেই, তার গ্রন্থে উল্লেখ করে গেছেন (দেখুন: Henry M. Morris,Men of Science Men of God, Master Books, 1992, p.13)।

বিখ্যাত পদার্থবিদ উইলিয়াম থমসন (লর্ড ক্যালভিন)–যিনি ছিলেন একজন ক্রিশ্চিয়ান ও থার্মোডিনামিকস্ (thermodynamics)-এর প্রতিষ্ঠাতা–স্রষ্টায় বিশ্বাস করতেন। তিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব-এর কড়া সমালোচক ছিলেন এবং এই তত্ত্বকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি প্রাণের উৎপত্তির পেছনে একজন স্রষ্টার হাত আছে বলে বিশ্বাস করতেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক রবার্ট ম্যাথুজ ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তার Unraveling the Mind of God-শীর্ষক গ্রন্থে একজন স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আকাট্য যুক্তি তুলে ধরেছেন।
এখানে আমরা এমন আরো কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করতে পারি যারা একজন স্রষ্টার অস্তিত্বে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং সে-বিশ্বাসের কথা বেঁচেথাকাকালীন নানানভাবে প্রকাশও করে গেছেন।
যেমন:
রবার্ট বয়েল (Robert Boyle), আধুনিক রসায়নের জনক আইওনা উইলিয়াম পেট্টি (Iona William Petty), পরিসংখ্যান ও আধুনিক অর্থনীতির ওপর ব্যাপক গবেষণা-কর্মের জন্য বিখ্যাত মাইকেল ফ্যারাডে (Michael Faraday), সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদদের একজন।গ্রেগরি ম্যান্ডেল (Gregory Mendel), বংশগতিবিদ্যার জনক। তিনি তার আবিস্কারের মাধ্যমে ডারউইনবাদের অসারত্ব প্রমাণ করেন লুই পাস্তুর (Louis Pasteur),  বিখ্যাত এই চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ডারউইনবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন জন ডালটন (John Dalton), পারমাণবিক তত্ত্বের জনক
ব্লেইস পাসক্যাল (Blaise Pascal), বিখ্যাত গণিতবিদ জন রে (John Ray), বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস স্টেনো (Nicolaus Steno), বিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস (Carolus Linnaeus), বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী জর্জেস কিউভিয়ার (Georges Cuvier), চিকিৎসা-বিজ্ঞানী, তুলনামূলক শবব্যবচ্ছেদবিদ্যার জনক।ম্যাথ্যু মাউরি (Matthew Maury), সমুদ্রবিদ্যার জনক
থমাস এনডারসন (Thomas Anderson), জৈব রসায়নের জগতের একজন দিকপাল

উপসংহারের আগে বাতাস কি দৈবক্রমে একটা এরোপ্লেন তৈরী করতে পারে?
বিখ্যাত পদার্থবিদ স্যার ফ্রেড হয়েল (Sir Fred Hoyle) পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রকারান্তরে এ-প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি তার গ্রন্থ The Intelligent Universe-এ লিখেছেন: “একটা টর্নেডোর ধাক্কায় হঠাৎ করে প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ একত্রিত হয়ে একটি বোয়িং-৭৪৭ তৈরী হয়ে যাবার সম্ভাবনা যতোটুকু, দৈবক্রমে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির সম্ভাবনাও ততোটুকু।”–(সূত্র: Nature, 12 November, 1981)।

স্যার হয়েলের ওই বক্তব্য সত্যই ইন্টারেস্টিং। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব এবং অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের জীবনচক্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, আমাদের বিবেক একজন মহান স্রষ্টার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়। একটা হারিকেন বা টর্নেডো যেমন দৈবক্রমে একটা এরোপ্লেন তৈরী করতে পারে না, তেমনি জীবনের মতো জটিল জিনিসের সৃষ্টিও দৈবক্রমে বা এমনি এমনি হতে পারে না। বিশ্বজগতের দিকে তাকালেও বিবেক বলে ওঠে যে, এ-বিশ্বজগত দৈবক্রমে বা এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি বা হতে পারে না। বিশ্বজগতের পরতে পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে একজন মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ; জগতের প্রতিটা আলাদা আলাদা সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে আছে মহা-পরিকল্পনার চিহ্ন। এ-পরিকল্পনাকারী আর কেউ নন, ইনি হচ্ছেন সেই মহান স্রষ্টা।
বস্তুত, ভূমির ওপরে বা মাটির নীচে বা সমুদ্রের অভ্যন্তরে বা আসমানে–সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জীব ও জড় বস্তু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এ বিশ্বজগত দৈবক্রমে ও কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া সৃষ্টি হয়নি বা হতে পারে না। সবকিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এবং নিখুঁত পরিকল্পামাফিক সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সৃষ্টি করেছেন একজন মহাজ্ঞানী ও অসীম ক্ষমাতাধর স্রষ্টা।

উপসংহার

মানুষের সৃষ্টির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু থাকতে পারে না। তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের পক্ষে তার সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে জানা। আমরা এই পুস্তিকায় এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, যা কিনা প্রতিটি মানুষের জীবনে সবচে বেশি গুরুত্ব বহন করে।
আমরা পাঠকদের আবারো মনে করিয়ে দিতে চাই যে, মানুষসহ এ-বিশ্বজগতের সবকিছুই যে সৃষ্ট–এ সত্য উপলব্ধি করবার জন্য একজন মানুষের বিপুল তথ্যের প্রয়োজন নেই। যে-কেউ একটু চিন্তা-গবেষণা করলেই বুঝতে পারবেন যে, তিনি সৃষ্ট। এ-ক্ষেত্রে নবী ইবরাহিমের বক্তব্য উল্লেখ করা যায়।
নবী ইবরাহিম এমন এক গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যে-গোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণভাবে একক স্রষ্টায় বিশ্বাস করতো না এবং মুর্তিপুজা করতো। যদিও তিনি স্রষ্টা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ইতিপূর্বে কারো কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেননি, নবী ইবরাহিম স্রেফ চিন্তা-গবেষণা করেই এ-সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পেরেছিলেন যে, তিনি নিজে সৃষ্ট এবং তার স্রষ্টা হচ্ছেন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহপাক। আল-কুরআনে নবী ইবরাহিমের কাহিনী এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে:
“অতঃপর রাত্রির অন্ধকার যখন তাহাকে (অর্থাৎ নবী ইবরাহিমকে) আচ্ছন্ন করিল, তখন সে নক্ষত্র দেখিয়া বলিল: ‘ইহাই আমার প্রতিপালক।’ অতঃপর যখন উহা অস্তমিত হইল, তখন সে বলিল: ‘যাহা অস্তমিত হয় , তাহা আমি পসন্দ করি না।’ অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হইতে দেখিল, তখন বলিল: ‘ইহা আমার প্রতিপালক।’ যখন উহাও অস্তমিত হইল, তখন সে বলিল: ‘আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না-করিলে, আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হইব।’ অতঃপর যখন সে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হইতে দেখিল, তখন বলিল: ‘ইহা আমার প্রতিপালক, ইহা সর্ববৃহৎ।’ যখন ইহাও অস্তমিত হইল, তখন সে বলিল: ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাহাকে আল্লাহর শরিক কর, তাহার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাহার দিকে মুখ ফিরাইতেছি, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নহি।’–(আল কুরআন, সুরা-আন’আম, আয়াত-৭৬-৭৯)।

নবী ইবরাহিমের উদাহরণ থেকে এটা ষ্পষ্ট যে, বোধসম্পন্ন একজন যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে এ-কথা উপলব্ধি করা কঠিন নয় যে, এ-বিশ্বজগত একজন একক স্রষ্টার সৃষ্টি এবং এ-বিশ্বজগত সৃষ্টি করা হয়েছে নিখুঁত পরিকল্পনার সাহায্যে; এ-সৃষ্টির কাজে কোনো খুঁত খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সন্দেহ নেই, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান মানুষের কাছে এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক একটা ব্যাপার যে, একশ্রেণীর লোক স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বা করতে চায়। এই অস্বীকারকারীদের সামনেও কিন্তু স্রষ্টার অসংখ্য নিদর্শন রয়ে গেছে। কিন্তু এরা এ থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করে না। কুরআনে আল্লাহপাক এসব অবিশ্বাসীর মনের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে:
“যদি তুমি বিষ্মিত হও, তবে বিস্ময়ের বিষয় তাহাদের এই কথা: ‘মাটিতে পরিণত হওয়ার পরও কি আমরা নূতন জীবন লাভ করিব?’উহারাই উহাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে এবং উহাদেরই গলদেশে থাকিবে লৌহশৃঙ্খল। উহারাই অগ্নিবাসী ও সেখানে উহারা স্থায়ী হইবে।”–(আল কুরআন, সুরা-রা’দ, আয়াত-৫)।

প্রিয় পাঠক! এই পুস্তিকায় যে-বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সে বিষয়টি অন্য যে-কোনো কিছুর চাইতে আপনার জীবনের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। হতে পারে যে, আপনি বিষয়টির গুরত্ব নিয়ে যথাযথভাবে এখনো চিন্তা করেননি, বা হতে পারে যে, আপনি ইতোপূর্বে বিষয়টি নিয়ে আদৌ কোনো চিন্তাই করেননি। তবে নিশ্চিতভাবে জেনে নিন যে, যে-স্রষ্টা আপনাকে সৃষ্টি করেছেন–সেই স্রষ্টাকে জানা এবং উপলব্ধি করা আপনার জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়।
একবার ভাবুন, কী কী দিয়েছেন তিনি আপনাকে। আপনি এমন একটি পৃথিবীতে বাস করেন, যে পৃথিবীটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। আরো বাড়িয়ে বললে, পৃথিবীকে বিশেষভাবে কেবল আপনার জন্যই সৃষ্টি করেছেন  মহান স্রষ্টা। অথচ, এর সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনার কোনো দূরতম সম্পর্কও ছিল না! একদিন আপনি এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে চোখ মেলে তাকালেন এবং নিজেকে আবিস্কার করলেন অসংখ্য নেয়ামাতের মাঝে!! আপনি দেখতে পারেন, আপনি শুনতে পারেন, আপনি অনুভব করতে পারেন…। এমনটি হয়েছে, কারণ, মহান স্রষ্টা এমনটিই চেয়েছেন।

আল কুরআনের একটি আয়াতে স্রষ্টা অর্থাৎ মহান আল্লাহপাক বলছেন:
“এবং আল্লাহ তোমাদিগকে নির্গত করিয়াছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ হইতে এমন অবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানিতে না। তিনি তোমাদিগকে দিয়াছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, এবং হৃদয়, যাহাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”–(আল কুরআন, সুরা-নাহল, আয়াত-৭৮)।

যেমনটি ওপরের আয়াতে বলা হয়েছে, এটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন যিনি আপনাকে সে-সব কিছুই দিয়েছেন, যা আপনার আছে এবং যিনি সেই বিশ্বজগতও সৃষ্টি করেছেন, যে জগতে আপনি বাস করছেন। তাই আসুন, স্রষ্টার ইচ্ছার কাছে আমরা আত্মসমর্পন করি এবং তার দেয়া সকল নেয়ামতের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তাহলে আমরা চিরন্তন কল্যাণ লাভ করতে পারবো। আর যদি আপনি উল্টোটা করেন, তবে তার জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে; সুখের পরিবর্তে পেতে হবে দুঃখ।
নিশ্চিত থাকুন যে, মহান স্রষ্টা আছেন এবং আপনার খুব কাছেই আছেন…
তিনি সে-সবকিছুই দেখেন এবং জানেন যা আপনি করেন…
তিনি সে-সবকিছুই শোনেন যা আপনি বলেন…
এবং নিশ্চিত থাকুন যে, আপনিসহ সকলকেই শিগগিরই তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে…

“তাহারা বলিল: ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদিগকে যাহা শিক্ষা দিয়াছেন, তাহা ছাড়া আমাদের তো কোনো জ্ঞানই নাই। বস্তুত, আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়।”–(সুরা বাকারা, আয়াত-৩২)
.
.
.
.
স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং কিছু বিভ্রান্তির অবসান
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
.
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই নিজেকে অন্য কারও কাছে সমর্পণ করার সহজাত প্রবণতা আছে। এই ‘অন্য কেউ’ হয় তার থেকে শক্তিশালী বা তার থেকে শ্রেষ্ঠতর কোনো একজন। আস্তিক এবং নাস্তিক- উভয়ের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য আছে, তা সে স্বীকার করুক বা না করুক। শুধু পার্থক্য হলো আস্তিকেরা এই কাজটা করে নিজের ধর্ম অনুযায়ী, আর নাস্তিকেরা কোনো ধর্মীয় নীতি ছাড়াই। তারা মানুষের মধ্যে বিশেষ কোনো শ্রেণীকে বা মানুষের তৈরি কোনো বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যেমন- নাস্তিকদের কাছে কোনো সমস্যার সমাধান চাওয়া হলে তারা কোনো উৎস থেকে পাওয়া চিন্তা বা যুক্তি দিয়ে উক্ত সমস্যা সমাধানের কথা বলে। এখানে তারা উক্ত চিন্তার উৎসকে চরম নির্ভরযোগ্য মনে করে এবং তার কাছে মাথা নত করে। বর্তমান কালের নাস্তিকদের কাছে এই ‘স্রষ্টা’র আসনে আছেন রিচার্ড ডকিন্স নামে এক বায়োলজিস্ট, একই সাথে তারা নিজেদেরকে ‘বিজ্ঞান’- এর দাস হিসেবেও স্বীকার করে নিয়েছে (যদিও বা তারা জানে যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব পরিবর্তনশীল এবং ধ্রুব সত্য নয়)। সমাজতন্ত্রীরা স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করলেও কার্ল মার্কস, লেনিন- এদেরকে তাদের প্রভু হিসেবে পরোক্ষভাবে মেনে নিয়ে নিজেদেরকে তাদের সামনে নত রেখেছে। কোন নাস্তিকের কাছে সমস্যার সমাধান চাওয়া হলে সে কখনও বলে না যে, ‘আমি কিছুই মানি না বা কিছুই বিশ্বাস করি না, তাই আমি কিছুই বলবো না।’ বরং সে তার লালিত বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়া কনসেপ্ট অনুযায়ী কথা বলা শুরু করে। এ ব্যাপারে অমুক বিজ্ঞানী এরকম বলেছেন, তমুক ঐরকম বলেছেন- এভাবে সে আসলে কোনো একটা নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সে এক্ষেত্রে তাদেরকেই প্রাধান্য দেয় যাদের সাথে তার চিন্তাধারা বা আদর্শের মিল আছে। মূলত সে তার এই বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, যার কারণে সে বার বার উক্ত উৎসের কাছে ফিরে যায়। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখবো যে, ব্যাপারটা সহজাত এবং সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। মানুষ তার শক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগেও যখন সফল হতে পারে না বা উদ্ধার পেতে পারে না, তখন সে নিজের অজান্তেই এক মহাশক্তির দারস্থ হয়। এটি মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি যা প্রত্যেকটা মানুষের ক্ষেত্রেই একই। এখানে এসে নাস্তিকেরা প্রশ্ন করতে পারে, ‘আসলে এই প্রবৃত্তির থেকেই স্রষ্টা, ধর্ম- এসবের জন্ম…’ চলুন, তাহলে আরও একটু গভীরে প্রবেশ করা যাক।

লক্ষ্য করুন, এখানে তারা বলছে যে এই প্রবৃত্তি থেকেই ঈশ্বরের ধারনার জন্ম, অথচ তারা কিন্তু এই প্রবৃত্তির উৎপত্তিটা কিভাবে হল- সেটি অনুসন্ধান করছে না। প্রত্যেকটি মানুষই এক আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের স্বাভাবিক অনুভূতি নিয়ে জন্মায়, জন্ম থেকেই মানুষ জানে যে আল্লাহ্‌ এক এবং আল্লাহ্‌ চান আমি তার ইবাদত করি– ইসলামের ভাষায় এই অনুভূতিকে ‘ফিতরাহ’ বলে। কী? ‘ফিতরাহ’ এর ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না? বৈজ্ঞানিক প্রমাণ লাগবে? তাহলে শুনুন। University of Oxford এর Centre for Anthropology and Mind বিভাগের সিনিয়র রিসার্চার Dr. Justin Berrett দীর্ঘ ১০ বছর শিশুদের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে বলেছেন:[১]

 
“Young people have a predisposition to believe in a supreme being because they assume that everything in the world was created with a purpose.”

“If we threw a handful (of babies) on an island and they raised themselves I think they would believe in God.”

 
“সাধারণত বাচ্চারা মনে মনে আগে থেকেই বিশ্বাস করে যে, একজন অতিপ্রাকৃত সত্তা কোনো একটি উদ্দেশ্যে এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছে… যদি কোনো দ্বীপে কিছু শিশুকে ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজেই বেড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া হয়, দেখা যাবে, তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে।”

আপনি যদি কোনো বিজ্ঞানী বা যুক্তিবাদীকে টেবিলের উপর একটা ল্যাপটপকে দেখিয়ে বলেন যে, এটা এখানে কেউ আনে নি, এটা আগে থেকেই এখানে ছিল, এটার কোন maker বা স্রষ্টা নেই। তাহলে সে আপনাকে চরম মূর্খ বলবে। কারণ এটা যে এমনি এমনি এখানে আসতে পারে না, সেটা বাচ্চা ছেলেও জানে। একটি মোবাইলের কথাই ধরুন, একটা মোবাইল ফোনের প্রধান উপাদান হলো বালি। যেটা হলো ভিতরের সেমিকন্ডাক্টর চিপের উপাদান আর উপরের কেসিংটা প্লাস্টিকের তৈরি। এখন একটা প্লাস্টিককে বালিতে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর রেখে দিলে একটা প্রোগ্রামেবল মোবাইল তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা (probability) কতটুকু? আবার, একটা বানরকে যদি কিবোর্ড দিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দেয়া হয়, তাহলে একটা অর্থপূর্ণ বাক্য, যেমন- I am a monkey, এটা পাওয়ার probability কত? এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়, দুটো ক্ষেত্রেই probability নির্ভর করছে বুদ্ধিমত্তার উপর। এই মহাবিশ্ব randomly তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক কম, যেটা Higher Intellectual ছাড়া probability বাড়ানো সম্ভব না।
 

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আপনি এই একই ধরনের প্রশ্ন যখন বিশাল কোনো কিছুর ক্ষেত্রে করবেন, অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে, তখন যদি আপনি বলেন, এটা আগে থেকেই ছিল- তাহলে সেই একই বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী আপনাকে বুদ্ধিমান বলে আখ্যায়িত করবে।

যদি কোনো নাস্তিককে প্রশ্ন করা হয়, মানুষ কিভাবে এসেছে, তাহলে সে আপনাকে বিবর্তনবাদের কথা বলবে। এখন যদি তাঁকে প্রশ্ন করেন সেই এককোষী অণুজীব বা first living cell কিভাবে আসলো? তাহলে সে আপনাকে ২ ধরনের উত্তর দিতে পারে-

১। এটা আগে থেকেই ছিল (!)।

২। Random Chemical process.

আপনি এখানেও একই প্রশ্ন করতে পারেন এগুলো কিভাবে শুরু হলো? সে বলবে সবই ‘প্রকৃতি’র তৈরি। কিন্তু এই প্রকৃতি যে কী জিনিস সেটার নির্ভরযোগ্য সংজ্ঞা আমি আজ পর্যন্ত কারও কাছে পেলাম না। এখানেও সেই একই প্রশ্ন চলে আসে, প্রকৃতিকে অস্তিত্বে আনলো কে? আপনি যদি বলেন এক মহাবিস্ফোরণের ফলে এই নিখুঁত সিস্টেমটা তৈরি হয়েছে, সেটা খুব লজিক্যাল কথা হবে না। ব্যাপারটা অনেকটা দুইটা ফেরারি এবং পোরশে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে একটা বিএমডব্লিউ গাড়ি তৈরি হওয়ার মতো! Explosion create chaos, not discipline. এখানেও একটা কথা আসে যে এই বিস্ফোরণটাই বা কিভাবে হলো বা কেন হলো? আর যদি বলেন এই বিস্ফোরণের আগে কি ছিল, তাহলে সে আপনাকে singularity-র কথা বলবে। সেটা কিভাবে হলো? এভাবে আপনি যে পথেই আগান না কেন আপনাকে এক সময় থামতেই হবে। আপনাকে কোনো একটা কিছু বা কোনো পয়েন্টকে constant বা reference ধরতেই হবে। এরপর সেটার ক্ষেত্রে বলতে হবে, ‘এটাকে কেউ সৃষ্টি করে নি। এটা আগে থেকেই ছিল। ছিল তাই ছিল!’

সুতরাং, আমরা বিজ্ঞান দিয়ে লজিক দেয়ার ক্ষেত্রেই বলি আর সাধারণ কমন সেন্স ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বলি এমন কিছুর অস্তিত্ব সবসময় থেকেই যাচ্ছে যাকে আমরা বিলীন করতে পারছি না। আমরা আস্তিকেরা এই অদৃশ্য সত্ত্বাকে স্রষ্টা বলি। এখন যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করে নেই, তাহলে প্রথমেই যেই প্রশ্নের উদয় হয় সেটা হলো, এই স্রষ্টা কি মহাবিশ্ব বা প্রকৃতি হতে পারে না? কেন সেটাকে আলাদা কোন সত্ত্বা ধরতে হবে? এর উত্তর হলো, না পারে না। যদি Big bang theory-র উপর ভিত্তি করে আমরা যুক্তি দাড় করাই, তাহলে এই তত্ত্ব অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। পৃথিবীর অন্যতম বড় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং নিজেও তার ওয়েবসাইটে এই সম্পর্কে লিখেছেন:

The conclusion of this lecture is that the universe has not existed forever. Rather, the universe, and time itself, had a beginning in the Big Bang, about 15 billion years ago. – The Beginning of Time, Stephen Hawking[২]

“এই বক্তৃতা শেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি যে, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব চিরকাল বিদ্যমান ছিল না। বরং, মহাবিশ্ব, এমনকি স্বয়ং সময়ের সূচনা হয়েছিল বিগ ব্যাঙ্গের মধ্য দিয়ে, প্রায় ১৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে।”
 

যার শুরু থাকে তার সৃষ্টি হওয়ারও একটা কাল থাকে, আর যে সৃষ্টি হয় – তার অবশ্যই একজন স্রষ্টা থাকে। কাজেই মহাবিশ্ব নিজে কখনোই স্রষ্টা হতে পারে না। আরও একটা ব্যাপার হল, মহাবিশ্ব বা প্রকৃতির কি বুদ্ধি বা চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? যদি না থাকে, তাহলে বুদ্ধিহীন প্রকৃতি কিভাবে বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি করে? আর যদি চিন্তা করার ক্ষমতা থেকেই থাকে, তাহলে তো নাস্তিকরা আর স্রষ্টা নাই বলে চিল্লানোর কোন সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু আমরা যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে দেখলাম যে, প্রকৃতি বা মহাবিশ্ব নিজেই সৃষ্ট। তাই এগুলোকে স্রষ্টা হিসেবে ধরে নেয়া যাচ্ছে না। একইভাবে, আমরা যদি অন্যান্য বৃহৎ কোনো কিছুর দিকে লক্ষ করি তাহলেও দেখবো যে আকৃতির বিশালতা এবং কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য ছাড়া কারও মধ্যেই আসলে খুব বেশি পার্থক্য নেই। যেমন- সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত এদের কারও কোন বিচারবুদ্ধি নেই; সবই জড় পদার্থ। অতএব, এদের কেউই স্রষ্টা না।

“তারা কি সৃষ্ট, নাকি না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? নাকি তারা সৃষ্টি করেছে আকাশসমূহ ও পৃথিবী? বরং (বাস্তবতা তো এই যে,) তারা বিশ্বাসই রাখে না। তোমার প্রতিপালকের ভাণ্ডারসমূহ কি তাদের কাছে, নাকি তারাই (সবকিছুর) নিয়ন্ত্রক?” [সূরা তূর ৫২: ৩৫-৩৭]

আমাদের কাছে এখন আছে কেবল একটাই option. স্রষ্টা সম্পূর্ণ আলাদা সত্ত্বা। এখন দ্বিতীয় ধাপে আমাদের মাথায় যে প্রশ্ন আসে সেটি হল, স্রষ্টা যদি সবকিছু সৃষ্টি করেই থাকে তাহলে তাঁকে সৃষ্টি করলো কে? এখানে আমরা স্রষ্টার সৃষ্টি হওয়া নিয়ে ৩ টা তত্ত্ব পাই।

১। স্রষ্টা নিজেকে নিজেই সৃষ্টি করেছেন।

২। স্রষ্টাকে কেউ সৃষ্টি করেছেন।

৩। স্রষ্টাকে কেউ সৃষ্টি করে নি। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন।

প্রথমটি হবে না। কারণ নিজেকে সৃষ্টি করতে হলে প্রথমে নিজের অস্তিত্ব থাকতে হয়। আর যার নিজের অস্তিত্ব আছেই, তার নিজেকে সৃষ্টি করার প্রশ্নটাও অবান্তর। এটা কিভাবে সম্ভব যে যিনি আগে থেকেই ছিলেন (নিজেকে সৃষ্টি করার জন্য), আবার একইসাথে সৃষ্টিও হচ্ছিলেন??!!

দ্বিতীয়টিও অযৌক্তিক। কারণ স্রষ্টাকে যদি অন্য কেউ তৈরি করে থাকে, তাহলে তো স্রষ্টা আর স্রষ্টা থাকেন না। তিনিও আমাদের মত সৃষ্ট হয়ে যান। বরং তাঁকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই প্রকৃত স্রষ্টা। তাহলে তাঁকে কে সৃষ্টি করেছে? সেই মহাসত্তাকে যে সৃষ্টি করেছে, সেই মহা-মহাসত্তাকে কে সৃষ্টি করেছে? সেই মহা-মহাসত্তাকে যেই মহা-মহা-মহাসত্তা সৃষ্টি করেছে, তাকে কে সৃষ্টি করেছে?… এই প্রশ্নের শেষ নেই। এটা চলতেই থাকবে। আর এটা সম্ভব না, কারণ একটু আগেই আমরা দেখেছি যে প্রকৃতি বা মহাবিশ্ব সৃষ্ট। আর যে সৃষ্ট তার পক্ষে আগে থেকেই থাকা সম্ভব না।

ধরুন আপনি একজন সৈনিক। আপনাকে গুলি করার আগে আপনার পেছনের একজন সৈনিকের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তাকেও তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নিতে হবে, আপনাকে অনুমতি দেওয়ার আগে। এভাবে পেছনের দিকে অসীম সময় পর্যন্ত অনুমতি নেওয়া চলতে থাকবে। যদি তাই হয়, তাহলে আপনি কি কোনোদিন গুলি করতে পারবেন? পারবেন না। আপনাকে অবশ্যই কারও নির্দেশকে ধ্রুবক ধরে সেই কমান্ডকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা প্রমাণ করে যে, এরকম পেছনের দিকে অসীম পর্যন্ত চলতে থাকা একটি অবাস্তব ধারণা। এরকম হলে কোনোদিন কোনো ঘটনা ঘটতো না। সুতরাং, কখনই অসীম পর্যন্ত কোনো ঘটনার পেছন দিকে যাওয়া যায় না।

আরেকটা উদাহরণ দেখি। আপনার সামনে যদি ৫০০ জন থাকে, তাহলে আপনি ৫০০ জনের পরে বাসে উঠার সুযোগ পাবেন। যদি আপনার সামনে ১০০০ জন থাকে তাহলে আপনি ১০০০ জনের পরে বাসে উঠতে পারবেন। কিন্তু যদি আপনার সামনে অসীম সংখ্যক লোকের লাইন থাকে, তাহলে কি আপনার বাসে উঠার পালা কখনো আসবে? না, কখনো আসবে না। কেননা, অসীম সংখ্যক লোকেরও বাসে উঠা কখনও শেষ হবে না, আর আপনারও বাসে উঠার পালা কখনোই আসবে না। এবার উল্টোভাবে চিন্তা করুন। ধরুন, একটা লোক তার সামনের লোকদের বাসে উঠার পরে সে বাসে উঠেছে। এখন এই লোকটা কত জনের পর উঠেছে? যত জনের পরেই উঠুক না কেন, সেটার অবশ্যই একটা সীমা আছে। একথা বলা যাবে না যে, সে অসীম সংখ্যক লোকের পর বাসে উঠেছে। কেননা তার সামনে যদি অসীম সংখ্যক লোকই থাকতো, তাহলে তো সেই অসীম সংখ্যক লোকেরও কোনদিন বাসে উঠা শেষ হতো না, আর তারও কোনদিন বাসে উঠার পালা আসতো না। কিন্তু যেহেতু তার পালা এসেই গেছে, বাসে যেহেতু সে উঠেই গেছে- এটাই অকাট্য প্রমাণ যে সে সসীম ও নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু লোকের পর বাসে উঠেছে। ঠিক তেমনি এই মহাবিশ্ব যেহেতু অস্তিত্বে এসেই গেছে, এটাই অকাট্য প্রমাণ যে এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছনে কারণের কোনো অসীম লাইন নেই। বরং শুরুতে এমন একজন স্রষ্টা আছেন যার পিছনে আর কোন স্রষ্টা নেই।

স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করলো, এই প্রশ্নের মাঝে একটা ফাঁক আছে। সেটা হলো প্রশ্নকারী বিনা প্রমাণে আগেই ধরে নিয়েছেন যে, স্রষ্টাকে সৃষ্টি করা হয়েছে; তিনি একসময় ছিলেন না। যেমন- আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন যে, স্রষ্টার সন্তান কয়জন? এর মানে হলো, আপনি আগেই বিনা প্রমাণে ধরে নিয়েছেন যে, স্রষ্টার সন্তান আছে। অথচ এরকম বিনা প্রমাণে কিছু ধরে নিয়ে, তার উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন করা একেবারেই অযৌক্তিক। এ ধরনের প্রশ্নকে বলা হয় loaded question বা complex question fallacy, যেটি কোন controversial বা unjustified assumption করে করা হয়।[৩] ‘এখনও বউকে পেটান?’- এরকম একটা loaded question, যেখানে ধরে নেয়া হচ্ছে- প্রথমত, আপনার বউ আছে। দ্বিতীয়ত, আপনি তাকে পেটাতেন।

তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণিত হবার পর, তাকে কে সৃষ্টি করলো- এই প্রশ্ন করার আগে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি একসময় ছিলেন না, তাকে পরে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা প্রমাণ না করে তাকে কে সৃষ্টি করলো, এই প্রশ্ন করাটা একেবারেই অযৌক্তিক। যেমন আমরা আগে প্রমাণ করেছি যে, এই মহাবিশ্ব একসময় ছিল না, পরে অস্তিত্বে এসেছে।

আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, তোমাদের কারো নিকট শয়তান আসতে পারে এবং সে বলতে পারে, এ বস্তু কে সৃষ্টি করেছে? ঐ বস্তু কে সৃষ্টি করেছে? এরূপ প্রশ্ন করতে করতে শেষ পর্যন্ত বলে বসবে, তোমার প্রতিপালককে কে সৃষ্টি করেছে? যখন ব্যাপারটি এ স্তরে পৌঁছে যাবে তখন সে যেন অবশ্যই আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায় এবং বিরত হয়ে যায়। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৩২৭৬]

আমাদের তাহলে তিন নম্বর থিওরিতেই যেতে হচ্ছে। অর্থাৎ, স্রষ্টা সম্পূর্ণ আলাদা সত্ত্বা, যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং অনন্তকাল ধরে আছেন এবং থাকবেন।

স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা সত্ত্বা এবং অনাদি-অনন্ত হিসেবে ধরে নেয়ার পর তৃতীয় ধাপে আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই, সেটি হল স্রষ্টা কি এক নাকি একাধিক?

আমরা যদি এই মহাবিশ্ব বা আমাদের চারপাশে তাকাই, তাহলে দেখবো যে সবকিছুই একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মে সুশৃঙ্খলভাবে চলছে। আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ এরুপ কোন অসঙ্গতিও আমরা দেখি না। যদি একাধিক স্রষ্টা থাকতো, তাহলে অবশ্যই এরকমটা দেখা যেত না। কারণ তাদের উভয়ই যেহেতু বিশাল ক্ষমতাবান, তাহলে তারা অবশ্যই নিজেদের উপর এবং তাদের সৃষ্টির উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করতো। কোনো বিজ্ঞানী কোনো সূত্র আবিষ্কার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতো যে, তার পরিশ্রম বিফলে গেছে। কারণ এক স্রষ্টা যেভাবে সিস্টেম ডিজাইন করেছিল, অন্য স্রষ্টা তার ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য আগের স্রষ্টার ডিজাইন বাতিল করে নতুন ডিজাইন তৈরি করেছে। এটা অবশ্যই ঘটত, কারণ উভয় স্রষ্টাই বিশাল ক্ষমতাবান। ক্ষমতাবান দুই স্রষ্টার মধ্যে এক স্রষ্টাই যদি সবসময় ক্ষমতা প্রদর্শন করতে থাকে, তাহলে অন্য স্রষ্টার ক্ষমতা আছে এর প্রমাণ কোথায়? আর এক স্রষ্টা অন্য স্রষ্টার কর্তৃত্ব মেনে নিবেনই বা কেন? আল্লাহ্‌ বলেছেন, “আল্লাহ্‌ কোনো সন্তান গ্রহণ করেন নি এবং তাঁর সাথে কোনো ইলাহ্‌ নেই। যদি থাকতো তাহলে প্রত্যেক ইলাহ্‌ স্বীয় সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং এঁকে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতো।” [সূরা আল-মু’মিনূন ২৩: ৯১] 
যদি একাধিক স্রষ্টা থাকতো, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বহু মৃত ব্যক্তি হরহামেশাই জীবিত হত!

অর্থাৎ, একাধিক স্রষ্টা থাকাও সম্ভব না। তারমানে স্রষ্টা হল একক, তার সৃষ্ট সবকিছু থেকে আলাদা, অনাদি-অনন্ত, সর্বশক্তিমান সত্ত্বা। আল্লাহ্‌ কুরআনে নিজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন-

“১। বল, তিনিই আল্লাহ্‌, এক ও অদ্বিতীয়।

২। আল্লাহ্‌ কারও মুখাপেক্ষী নন।

৩। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয় নি।

৪। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।” [সূরা ইখলাস ১১২: ১-৪]

তথ্যসূত্র:

• [১] http://www.telegraph.co.uk/news/religion/3512686/Children-are-born-believers-in-God-academic-claims.html

• [২] http://www.hawking.org.uk/the-beginning-of-time.html

• [৩] https://en.wikipedia.org/wiki/Loaded_question

• স্রষ্টার অস্তিত্ব, অতঃপর… – এম. ডব্লিউ. জেড. মুন্না

• http://www.hamzatzortzis.com/2425/divine-singularity-how-do-we-know-god-is-one/
.
.
.
.
নাস্তিকদের প্রতি অতি সাধারণ কিছু চ্যালেঞ্জিং প্রশ্ন
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
.
[১] নাস্তিকরা মুসলিমদেরকে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে বলে। মুসলিমরা যুক্তির পর যুক্তি দিলেও নাস্তিকদের কাছে এ পর্যন্ত কোনো যুক্তিই মনঃপুত বা গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার মানে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, নাস্তিকরা আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখেই তবে তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায়। কিন্তু মুসলিমরা যতই গলা ফাটিয়ে বলুক না কেনো আল্লাহ একজন অদৃশ্য সত্তা, মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তাকে চোখে দেখানো সম্ভব নয় – নাস্তিকদের কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করে না। কাজেই মুসলিমরা হাজারো যুক্তি দিলেও তারা যেহেতু আল্লাহকে নাস্তিকদের চোখের সামনে হাজির করে দেখাতে পারে না, সেহেতু নাস্তিকরা মুসলিমদেরকে ‘অন্ধ বিশ্বাসী’ বলে হেয় করে। কেউ নাস্তিকতায় অন্ধ বিশ্বাসী হলে আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু তাই বলে ব্যাপারটা তো আর মগের বা নাস্তিকদের মুল্লুক হতে পারে না যে, তারা যা বলবে তা-ই ঠিক।

আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে, এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা সম্পর্কীত প্রশ্নটি (স্রষ্টা আছে কি নেই) যেমন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আবার এই প্রশ্নের উত্তরও সবেচেয়ে জটিল। আর তা-ই যদি হয় তাহলে একই সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে সহজ-সরল ও প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা অতি আবশ্যক। এজন্য নাস্তিকদের প্রতি অতি সাধারণ

অথচ চ্যালেঞ্জিং কিছু প্রশ্ন রাখা হলো:

১.১ আল্লাহ বা স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে ‘প্রমাণ’ বলতে নাস্তিকরা আসলে কী বুঝাতে চায়? কী ধরণের ‘প্রমাণ’ দেখালে তারা স্রষ্টার অস্তিত্বকে মেনে নেবে, এবং কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুসলিমদেরকে উদ্দেশ্য করে ‘প্রমাণ নাই’ ‘প্রমাণ নাই’ ‘প্রমাণ নাই’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করার পেছনে উদ্দেশ্য কী?

১.২ একজন জন্মান্ধের কাছে নাস্তিকরা তাদের নিজেদের অস্তিত্ব কিংবা একটি উদাহরণ হিসেবে তাদের গুরু রিচার্ড ডকিন্সের অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেখাতে পারবে কি-না? তারা যদি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কি তারা মেনে নিতে রাজি আছে যে, বাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নাই?

১.৩ ধরা যাক কেউ দাবি করলো এই বলে যে, একটি মোবাইল সেটটার কোনো মেকার নাই বা থাকার দরকার নাই। নাস্তিকরা যেখানে পুরো মহাবিশ্বের মেকারকে অস্বীকার করছে সেখানে এই ধরণের অতি মামুলি দাবি তো যে কেউই করতে পারে (তাছাড়া জন্মান্ধদের ব্যাপারটা তো রয়েই যাচ্ছে যাদেরকে কিছুই দেখানো সম্ভব নয়)। নাস্তিকদের বিশ্বাস অনুযায়ী মোবাইল সেটটার যদি মেকার থাকে বা থাকার প্রয়োজন হয় তাহলে তাদেরকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দেখাতে হবে। তারা যদি কোনো প্রমাণ বা যুক্তি দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে কি তারা মেনে নিতে রাজি আছে যে, এই মোবাইল সেটের কোনো মেকার নাই বা থাকার দরকার নাই?

[২] নাস্তিকরা মুসলিমদেরকে কোরআন যে আল্লাহর বাণী তা প্রমাণ করতে বলে। মুসলিমরা এ পর্যন্ত অসংখ্য যুক্তি দেওয়া সত্ত্বেও নাস্তিকদের কাছে কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাদের কাছে সবই নাকি হাস্যকর রকমের কু-যুক্তি। ভালো কথা। গ্রহণযোগ্য হতেই হবে, এমন কোনো কথা নাই। কিন্তু এক্ষেত্রেও তারা মুসলিমদেরকে ‘অন্ধ বিশ্বাসী’ বলে বিভিন্নভাবে উপহাস-বিদ্রূপ করে। ব্যাপারটা যেহেতু ফ্রী-লাঞ্চ নয় সেহেতু এবার নাস্তিকদের পালা।

কোরআনের বাণীর সাথে যেহেতু অদৃশ্য স্রষ্টার সম্পর্ক আছে বলে দাবি বা বিশ্বাস করা হয় সেহেতু অদৃশ্য কারো বাণী নিয়ে ভাবার আগে দৃশ্যমান কারো বাণী নিয়ে ভাবাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কোরআনকে যারা আল্লাহর বাণী প্রমাণ করতে বলে তাদেরকে আগে নিদেনপক্ষে নিম্নোক্ত দুটি বিষয়ে প্রমাণ দেখাতে হবে:

২.১ তাদের কেউ যদি কোনো বই বা প্রবন্ধ লিখার দাবি করে থাকে তাহলে সেই বই বা প্রবন্ধ যে তার নিজের লিখা, অন্য কারো নয়, সেটি প্রমাণ করে দেখাতে হবে। চ্যালেঞ্জ থাকলো।

২.২ “প্রজাতির উৎপত্তি” নামক বইটির লেখক যে চার্লস ডারউইন নিজেই, অন্য কেউ নয়, তা প্রমাণ করতে হবে। এক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ থাকলো।

উল্লেখ্য যে, উপরের প্রশ্নগুলো অনেক আগেই করা হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্তও কেউ জবাব দেয়নি।

এই ধরণের প্রাথমিক ও অতি সহজ কিছু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘাড়তেড়ার মতো একতরফা ভাবে মুসলিমদেরকে “আল্লাহর অস্তিত্ব” আর “কোরআন আল্লাহর বাণী” প্রমাণ করতে বলা এবং অবশেষে তাদেরকে ‘অন্ধ বিশ্বাসী’ বলে উপহাস-বিদ্রূপ করা চরম গোঁড়ামী আর অন্ধত্ব ছাড়া কিছু নয়, এমনকি অসততাও বটে।

[Note: এই লেখায় আল্লাহ্‌ / ঈশ্বর / সৃষ্টিকর্তা / God সমার্থকরূপে ব্যবহার করা হয়েছে ]
.
.
.
.
Conversation & Debate
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
.
১// মুফতি মাসুদের লাইভে সৃষ্টকর্তার প্রমান দিলেন ফেরদৌস ভাই।
.
https://youtu.be/ZLa615fvVn4
.
২// স্রষ্টার অস্তিত্ব কি,তাঁকে কে সৃষ্টি করেছে,তিনি কি এমন কিছু তিনি বানাতে পারবে যা তিনি ধ্বংস…
.
https://youtu.be/9zPLb4TPhlE
.
৩// বিষয়ঃ স্রষ্টার অস্তিত্ব : মূর্খ নাস্তিকের তেনাপেচানি- এমকে হাসান VS মুক্তমনা
.
https://youtu.be/HzIVQKXqjLQ
.
৪// স্রষ্টার অস্তিত্বের আর্গুমেন্ট খুব চমৎকার করে বুঝিয়ে দিলেন এই মুসলিম ভাই
.
https://youtu.be/ntEhy3DgTiQ
.
৫// নাস্তিক্যবাদের অস্তিত্ব সংকটে এবং কিছু প্রশ্ন ???
.
https://youtu.be/kdKHc0MaP3g
.
৬// স্রষ্টা নাই প্রমান করতে যেয়ে স্রষ্টা আছে প্রমান হয়ে গেল
.
https://youtu.be/K4KnNYxqHHg
.
৭// স্রষ্টার অস্তিত্বের আর্গুমেন্ট সমূহ by মোঃ আলী
.
https://youtu.be/1wGLFinsIj0
.
৮// বিগব্যাং এবং স্রষ্টা তথ্য নিয়ে নাস্তিকের সাথে বেলায়েত ভাইয়ের আলোচনা
.
https://youtu.be/bzhhTaPwsEU
.
৯// সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ক্ষেত্রে কারা বেশি যৌক্তিক ? মুসলিমরা নাকি নাস্তিকেরা !!!
.
https://youtu.be/wwaKEFkh7TA
.
১০// নাস্তিক আস্তিক ঐতিহাসিক আলোচনা ও স্রষ্টার অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ-কৃতজ্ঞতা-এম কে হাসান ভাই
.
https://youtu.be/yO1rRawUMCU
.
১১// আমাদের কেন স্রস্টা দরকার ??? স্রস্টা বিহীন সব ব্যাখ্যা অযৌক্তিক ?
.
https://youtu.be/MiE8Z0FQKFk
.

Leave a comment

search previous next tag category expand menu location phone mail time cart zoom edit close